Tuesday 15 January 2019

শীত গতপ্রায়

আবার একটা শীত গতপ্রায়;
এই শীতেও তুমি জানলেনা
হেমন্তের জাতক এক তোমাকে চাইতো অকারণ!
মাঘের শেষবেলায় এ শহর
অধিক কুয়াশায় ঢেকে যাবে,
হু হু উত্তুরে হাওয়া তোমাকে থমকে দেবে ক্ষণকাল! অতর্কিতে তোমার সিঁথির রঙ
লালে লাল হয়ে যাবে গত শতাব্দীর কোনো সিঁদুরের রঙে; তুমি যাকে ভেবেছো সদ্য পলাশ।
কার্পাসের ঝড় উঠবে, রোদ্দুর সরে যাবে তোমার শহর থেকে.....গেলো বছরের মতো আবারও তোমার মুখ রাঙিয়ে তুলবে
কোনো চৈত্র বিকেলের মরে আসা গোলাপি আলো; তবু সে রূপ প্রত্যক্ষ করে আর কেউ প্রেমে পড়বেনা!!
মোমের গলন্ত আলোয় তোমার মুখ প্রাচীন মিশরের কোনো এক নববধূর মতো;
তুমি জানলেনা কিছু, বহুদূর থেকে সেও কুয়াশার হিমগন্ধে তোমাকে ভেবেছে।।
                            

Monday 24 December 2018

বড়দিন!!

খিদের পেটে অসহ্য এ অন্ধ শীতের রাত
সান্টাক্লজ পারবে দিতে এদের মুখে ভাত?
চাʼয়ের দোকান জুটমিলেতে ছুটতে হবে রোজ
ওরাও শিশু কিন্তু ওদের নেই সান্টাক্লজ!
খিদের শহর ফুটপাতে পড়ে দেখলেনা তুমি ফিরে
তোমার স্লেজ ছুটছে শুধুই ধনীদের ঘরে ঘরে।
সাদা ধবধবে বিছানা, ঝুলছে মাথার ওপর মোজা
তখন এরা ছুটছে নিয়ে মাথায় ইঁটের বোঝা;
এদের স্বপ্নে সান্টা আসেনা, স্বপ্ন গরম ভাত
মায়ের চোখেতে সারাদিন জল, কুষ্ঠ বাবার হাত;
এদের ভীষণ ছোট্ট স্বপ্ন, গেম, টয় এরা চায়না
মাথার ওপর শূণ্য আকাশ
মোজা ঝোলাতে হয়না;
এদের তুমি কি দেবে সান্টা?
আসোনা এদের কাছে
তাই বড়লোকের কল্পনা তুমি
ধনীর শিশুর কাছে!
পেট ভরে শুধু ভাত খেতে দাও
হাতে তুলে দাও বই;
দেবসেনাপতি বলছে
বড়দিন সফল হবে তবেই॥

Sunday 4 November 2018

মুগুর প্রতিশোধ

কাহিনী ও চিত্রনাট্য- দেবসেনাপতি
চিত্রনাট্য সহায়তা ও অলংকরণ- সুমন্ত্র পাল

Thursday 27 September 2018

বৈঠকখানায় বিকেল


এই বৈঠকখানা অনেক কিছুর সাক্ষী ছিলো!
যেখানেতে রোজ দুবেলা ক্লায়েন্ট জমে,
আলগা থেকে চাঁচাছোলা আইনমাফিক আলোচনায়
হাতে হাতে গোল্ডফ্লেক, আর চায়ের ধোঁয়ায়;
এইখানেতে অনেক স্মৃতির সাক্ষী ছিলো!
এই ঘরটায় মৃত বিকেল ফুল ফোটাতো!!
এই ঘরটায় অনেক বিকেল তোমার মুখে
নাছোড় হয়ে শেষবেলাকার আলো ফেলতো!
এই ঘরে কৃত্রিম বসন্ত জাল বিছোতো।
এই বৈঠকখানা অনেক গল্প জমিয়েছিলো।
মধ্যরাতে আঁধার হলে সমস্তদিক;
অ্যাকোরিয়াম নীলচে আলো ঠিক জ্বেলে দেয়
ভেতর থেকে রঙিন মাছে আমায় দেখে
কী নিদারুণ অভিমানের নকশা আঁকে!
জানতো ওরা, খুন হওয়া এক বিকেলবেলা
বলার ছিলো অনেক কথা, হয়নি বলা
বৈঠকখানা আইনগত আলোচনার
এইখানেতে আবেগগুলোর ঢুকতে মানা।
আর কখনো এমন বিকেল ফিরবেনা ঠিক
সহস্রকাল আসবে বিকেল বিশ্রী অলীক;
একলা ঘরটা কাঁদবে তখন আপনমনে
শেষবেলাকার রোদ্দুর শুধু বুলিয়ে যাবে।
এইখানে রোজ দুবেলাতে লোক জমে যায়,
আইনকানুন সমস্যাতে হাতড়ে বেড়ায়;
কোর্ট কাছারির গল্প জমে এইঘরেতেই
সেরেস্তাঘর, অভিমানের জায়গা তো নেই।।
                                              

Friday 14 September 2018

ফ্র‍্যাঙ্কের স্বপ্ন

অনুবাদ ও বর্ণ সংস্থাপন- দেবসেনাপতি নন্দী

Saturday 18 August 2018

এসো আজ একবার (গুলজারিশ- ১৭)

এসো, আজ পুরনো কোনো বন্ধুর
দরজায় কড়া নেড়ে দেখি।
দেখি তার স্বপ্নের ডানাদুটো
আগের মতোই আছে নাকি;
অথবা সময়ের কালগ্রাসে জীবনের
দশচক্রে ইন্দ্রের বজ্রের ঘাতের মতো
মৈনাক পর্বত হয়ে সংসার সমুদ্রে
ডুবোপাহাড় হয়ে আছে!
এসো দেখি আগের মতোই ডেকে নেয় কিনা;
আগের মতোই হেসে ওঠে কিনা কথায় কথায়
নাকি তোমাকে ফিরিয়ে দিতে চেয়ে
নিঃশব্দে ঘড়ির দিকে চেয়ে নীরবে বুঝিয়ে দেয়
"আর কেন বাপু? এবার ওঠো!''
আসলে তোমার কাছাকাছি থাকা মানে
হঠাৎ করেই তার জাতিস্মরের মতো
যৌবনে ফিরে যাওয়া বারবার;
তোমাকে ফিরিয়ে দিতে চাওয়া মানে
সে পালাতে চায় তার পূর্বাশ্রম থেকে।।
                                       

Friday 13 July 2018

অভিশপ্ত ঈউনিকর্ণ

ঝড়ের উত্তাল দাপটে জাহাজটা কেঁপে কেঁপে উঠছে বারংবার। চারʼপাশে কোনো কিনারা কোনো চর দেখা যাচ্ছেনা; বিদ্যুতের উদ্যত শিখা আকাশটাকে চিরে দিচ্ছে ফালা ফালা করে। অন্ধকারে বিদ্যুতের ঝলকে মাঝে মাঝে দৃশ্যমান উঠছে জাহাজটার নাম, ঈউনিকর্ণ! জাহাজের নাবিক, খালাসিরা পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে; চেহারা আর পোশাক দেখলেই বোঝা যায় এরা পর্টুগীজ জলদস্যু। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করোটি পতাকাটা জাহাজের মাথায় তখনো নির্লজ্জের মতো উড়ছিলো; দুজন খালাসি একটানা জল ছেঁচে ফেলছে। ক্যাপ্টেন চিৎকার করে বললেন, "ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজ ডুবে যাবে; অপ্রয়োজনীয় জিনিষ ফেলে দাও সমুদ্রে...... এক্ষুণি!!" দলে দলে টেবিল চেয়ার বাক্স সব সমুদ্রে ছুঁড়ে  ফেলতে শুরু করলো খালাসিরা। এক একটা পাগলাটে ঢেউ এর ধাক্কায় সজোরে উল্টে আসছিলো ঈউনিকর্ণ! অভিজ্ঞ নাবিক বুঝলেন; আর বেশিক্ষণ বাঁচা যাবেনা। তিনি ছুটে বেড়িয়ে এলেন তাঁর ঘর থেকে; চিৎকার করে ডাকলেন, "ফ্র্যা--ন্সি--স!!" পরক্ষণেই বিশাল একটা পাহাড়ের মতো অন্ধকারকে আরো অন্ধকার করে একটা ছায়ামূর্তি নেমে এলো দড়ির সিঁড়ি বেয়ে। পরণে আপাদমস্তক জলদস্যুর পোশাক; কালো কাপড়ে একটি চোখ ঢাকা, বোঝাই যায় ওই কালো কাপড়ের নিচে যেখানে একটা চোখ থাকার কথা সেখানে আছে শুধু কালো গহ্বর। তবে সেই চোখটা কেমন ছিলো বোঝা যায় অক্ষত চোখটা দেখে; একটা সরু বাজপাখির মতো ক্রুর চোখ। মুখে লালদাড়ি, বিশাল পাথরের মতো বুক। এই মানুষটা যে এই জলদস্যুদের সর্দার, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। জীবন্ত বিভীষিকার মতো মানুষটা জলদগম্ভীর স্বরে বললো, "কী ব্যাপার কাপ্তান? কি বুঝছো?" ক্যাপ্টেন লোকটি ইহুদি, তিনি বললেন, "ফ্র্যান্সিস, পরমপিতা যিশুর নাম করো; আমরা কেউ আর বেশিক্ষণ বাঁচবোনা!" ফ্র্যান্সিস হিংস্র দাঁত বের করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, "মানে? এই সামান্য ঝড়ের তুমি মোকাবিলা করতে পারবেনা কাপ্তান?" ক্যাপ্টেন হাতজোড় করে বললো, "ফ্র্যান্সিস; অসম্ভব! জাহাজের মাস্ত্তল ভেঙেছে, বিভিন্ন জায়গায় ফুটো হয়েছে। জল ঢুকছে ক্রমাগত, এর পরেও বাঁচার আশা করা অসম্ভব!" ফ্র্যান্সিস দানবের মতো বিরাট বুকে চাপড় মেরে গর্জন করে উঠলো, "কোনো উপায় কি নেই কাপ্তান? বলো!!! কোনো উপায় নেই?" ক্যাপ্টেন বললেন, "হ্যাঁ, একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে পারি ফ্র্যান্সিস; যদি রাজি থাকো।" ফ্র্যান্সিস চিৎকার করে উঠলো, "কি কি কি??? কি উপায়?" ক্যাপ্টেন কাঁপা গলায় বললেন, "লুঠ করা ধন সম্পত্তির বাক্সগুলো সমুদ্রে ফেলে দিলে কিছুটা ভার কমতেও পারে জাহাজের....!" "কা-প্তা-ন!"ক্যাপ্টেনের কলার চেপে ধরে গর্জন করে উঠলো ফ্র্যান্সিস। ভয়ে চমকে উঠলেন প্রৌড় ক্যাপ্টেন, টাকমাথা মোটাসোটা মানুষ! কপালের ঘাম মুছে বললেন, "ফ্র্যা-ফ্ফ্র্যান্সি-স! কেউ যদি নাই বাঁচলাম, অর্থের লোভ করে কি হবে?" ফ্র্যান্সিস ঝড়, বজ্রপাত, বৃষ্টি, সমুদ্রের গর্জনের উপরে হিংস্র গর্জন করে উঠলো, "আমার সাত বছরের লুঠ করা বিরাট খাজ়ানা!! ফেলে দেবো? সমুদ্রে ফেলে দেবো আমি? কক্ষণো না! এই খাজ়ানা যেখানে.....আমি সেখানে!! শুনে রাখো কাপ্তান, যদি মরি.....ওই খাজ়ানা বুকে নিয়ে মরবো!ʼʼ এই সময় একজন কাফ্রি জলদস্যু খালাসি ছুটে এলো, কানে মাকড়ি, সাদা হাতকাটা বেনিয়ান পরিহিত, কষ্ঠি পাথরের মতো শরীর! লোকটি হাতজোড় করে চিৎকার করে উঠলো, "হুজুর.....সব্বোনাশ হয়েছে হুজুর!" ফ্র্যান্সিস আর ক্যাপ্টেন দুʼজনেই একসাথে বললেন, "কী-ক্কী? কী হয়েছে মবোগো?" মবোগো নামের লোকটি বললো, "জাহাজের একদিক ধ্বসে পড়েছে হুজুর...." কথাটা শেষ হলোনা; বিরাট একটা ঢেউ আছড়ে পড়ে পুরো জাহাজকেই গিলে নিলো এক নিমেষে। সমস্ত দুর্যোগের শব্দকে ছাপিয়ে অজস্র অসহায় আর্ত মানুষের চিৎকার শোনা যাচ্ছিলো তখনো। ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের সেই দিনটায় এক ঐতিহাসিক সলিল সমাধি হয়েছিলো আটলান্টিক মহাসাগরে!

টিভির পর্দায় একটি স্মার্ট আইরিশ মেয়ে বলছিলো খবরটাঃ ʼগত ১৮ই অগস্ট, ২০১৫ একটি অভিযাত্রী জাহাজ আটলান্টিক মহাসাগরের বুক থেকে নিরুদ্দিষ্ট। জাহাজটির কোনো হদিশই আর পাওয়া যায়নি। এর আগে ৪ঠা ফেব্রুয়ারী এভাবেই আরেকটি অভিযাত্রী জাহাজও আটলান্টিক মহাসাগরের বুক থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছিলো। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, দুটি জাহাজই তাদের শেষ তারে জানিয়েছে তারা একটা ভগ্ন প্রাচীন জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পেয়েছে সমুদ্রের মাঝখানে। অদ্ভুত ভাবে সেই ধ্বংসাবশেষ ডুবোপাহাড়ের মতো সমুদ্রের বুকের উপর দাঁড়িয়েছিলো।ʼএই অবধী শুনে চুরুটটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে প্রফেসর রোজ়ারিও বললেন, "জাহাজের ধ্বংসাবশেষ? ঈউনিকর্ণ নয় তো?" পাশের সোফায় বসেছিলেন তাঁর স্ত্রী ডরোথি, তিনি বললেন, "ঈউনিকর্ণ? সেটা কী রোজ়ারিও?" প্রফেসর সোফায় মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চুরুটে একটা বড় টান দিয়ে বললেন, "আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে এ এক বহুদিনের কিংবদন্তী ডরোথি। কেউ বলে প্রবাদ, কেউ বলে মরীচিকা; অনেকটা বারমুডা ট্র্যাঙ্গলের মতো।" প্রফেসর সোফা ছেড়ে উঠে ওঁর লাইব্রেরী ঘরে ঢুকে গেলেন, ডরোথি জানেন এই মানুষটাকে; একবার একটা বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করলে সহজে ছাড়বেননা। প্রফেসর রোজারিও আসলে একজন ইতিহাসবীদ, ইতিহাসের যে কোনো ঘটনা ওঁর নখদর্পণে। ওঁর ইতিহাসের যেকোনো ঘটনার প্রতি পাগলাটে আগ্রহের জন্য অনেকে ওঁকে বলে ʼপাগলা প্রফেসর।ʼ ডরোথিও সোফা ছেড়ে উঠে লাইব্রেরী ঘরে গিয়ে দেখলেন টেবিলে একটা পুরোনো জীর্ণ পৃষ্ঠার বইতে একাগ্রে মনোনিবেশ করেছেন প্রফেসর। ডরোথি বললেন, "রোজ়ারিও, ব্যাপারটা কি বললেনা?" প্রফেসর সিগারে লম্বাটে দুটো টান দিয়ে বললেন, "ষোলোশো ছাপ্পান্ন খ্রিস্টাব্দে আটলান্টিক মহাসাগরে এক প্রবল ঝড়ে ঈউনিকর্ণ নামে একটি জলদস্যু জাহাজ ডুবে গেছিলো। সেই জাহাজ ছিলো এক দুর্ধর্ষ পর্টুগীজ জলদস্যু ফ্র্যান্সিস ডেসার্টের। এক সময় তার অত্যাচারে বহু বানিজ্যিক জাহাজ সর্বস্বান্ত হয়েছিলো। আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে চলমান বিভীষিকার মতো ঘুরে বেড়াতো ফ্র্যান্সিস। তবে এরপর থেকে বহুবার বহু জাহাজ ওই ধ্বংসাবশেষের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অদ্ভুত ভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। আমার কাছে প্রচুর পেপার কাটিং আছে। প্রথম ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে একটা অভিযাত্রী জাহাজ হারিয়ে গেছিলো। তখন সেভাবে হইচই হয়নি; তারপরে ১৭১৪, ১৭৩২, ১৭৪৫ এ ও একই ঘটনা। শেষ তারে জানাচ্ছে তারা একটা জাহাজের ধ্বংসাবশেষের কাছে। অবশেষে আরো বাইশটি একই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে ১৮৬৭ তে অধ্যাপক ফ্রেডরিক একহার্টের অভিযাত্রী জাহাজও যখন একই ভাবে হারিয়ে যায়, তখন খুব হইচই হয়েছিলো। একহার্টের শেষ তারে জানা গেছিলো জাহাজের ধ্বংসাবশেষের গায়ে অস্পষ্ট লেখা ছিলো ʼঈউনিকর্ণ।ʼ ওই সময়ই বেশ কয়েকজন গবেষক, ইতিহাসবিদ প্রচুর গবেষণা করে ফ্র্যান্সিসের ঈউনিকর্ণের যুক্তি খাড়া করেন। কিন্তু এসবই তো কানামামার মতো....!তবে...." প্রফেসর থামলেন, বৃদ্ধ আর্দালি কফি আর টোস্ট এনেছে। ডরোথি উঠে গিয়ে ফায়ার প্লেসের আগুনটা একটু উসকে দিলেন। প্রফেসর আবার শুরু করলেন কফিতে চুমুক দিয়ে, "ডরোথি, আমার এই বিষয়ে একটা অভিজ্ঞতা আছে। প্রায় বছর দশেক আগে আমি এরিজ়োনার একটা জাহাজঘাটায় এক বদ্ধ উন্মাদের দেখা পেয়েছিলাম। সেও ক্যাপ্টেন ছিলো এক জাহাজের, তার জাহাজও হয়তো কখনো ঈউনিকর্ণের চক্রব্যুহে পড়েছিলো। ভাগ্যের ফেরে শুধু সে ফিরে এসেছিলো কোনোভাবে....! একমুখ সাদা দাড়ি, মাথায় নাবিকের টুপি, পরণে শতচ্ছিন্ন পোশাক। লোকটার গলা আজো আমার কানে বাজে, ও চেঁচিয়ে বলছিলো, ʼঈউনিকর্ণের কাছে কেউ যাসনা! কেউ না! ভুত.....ভুত! ফ্র্যান্সিসের ভুত!ʼ লোকটি এই হাসছে হা হা করে, আবার পরক্ষণেই হাউ হাউ করে কাঁদছে। কিন্তু পাগলের কথা কে শুনবে?" একটানা কথা বলে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রফেসর। ডরোথি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, "ঈউনিকর্ণের সঠিক ভেন্যু কি কেউ জানেনা?" প্রফেসর দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, "নাঃ! তবে হিসেব মতো জায়গাটা গ্রিনিচ মধ্যরেখা অনুসারে পশ্চিম দিকে। কারণ; ওইদিকেই ঘটনাটা প্রত্যেকবার ঘটেছে।" ডরোথি বললেন, "কিন্তু......এর কি কোনো প্রতিকার নেই রোজারিও? চিরকালই কয়েকটা নির্দোষ প্রাণ এভাবে এই চক্রব্যুহে শেষ হয়ে যাবে?" প্রফেসার ভ্রু কুঁচকে বললেন, "কে জানে!" ডরোথি একমুহুর্ত ভেবে নড়েচড়ে বসে বললেন, "আচ্ছা রোজ়ারিও, তোমার সূদুর ভারতবর্ষে সিক্রেট এজেন্সি 'কল্কি'র এসিপি অনঙ্গদেব কিছু করতে পারেননা?" প্রফেসারের চোখ মুহুর্তে চক্ চক্ করে উঠলো; তিনি সোজা হয়ে বসে একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন, "ঠি-ঠিক বলেছো ডরোথি। করলে অনঙ্গই এখন কিছু করতে পারে। অনঙ্গ.....অনঙ্গদেব রয়!"

ঘরটার দেওয়াল অনেকটা আয়নার মতো। চারদিকের দেওয়ালের কাঁচে ভেতরের ছায়া পড়বে, কিন্তু বাইরে থেকে ভেতরের কিছু দেখা যাবেনা; ঘষা কাঁচ। এই চৌকো ন্যানো লেন্সার ঘরে একটা কাঠের টেবিলের পেছনে চেয়ারে যে মানুষটা বসে আছেন, তাঁর বয়স পঞ্চাশ বাহান্ন; মাথার চুলে রুপোলি ছোঁয়া, চোখে স্টিলের ফ্রেম চশমা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো তাঁর পরণের স্যুট স্টেইনলেস স্টিলে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি, কোনো ভাঁজ নেই। তাঁর সামনের টেবিলে একটা ল্যাপটপ, একটা আইট্যাব, একটা টেলিফোন। এই ব্যাক্তির পরিচয় বোঝা যায় স্যুটের ডান বুকের লোগো দেখে, এসিপি অফ 'কল্কি'। এঁর নাম অনঙ্গদেব রায়; সিক্রেট এজেন্সি 'কল্কি'র এসিপি। দিল্লির সিবিআইও বিশেষ রহস্য সমাধানে এঁর সাহায্য নেন। অনঙ্গদেব রিসিভার তুলে নিয়ে তিনটি নম্বর ডায়াল করলেন; রিং হওয়ার আগেই ওপাশে একটি মেয়ের গলা, "স্যার!" অনঙ্গ বললেন, "এজেন্ট জিরো জিরো এইট;নাওউ।" মেয়েটি ওপারে বললো, "ইয়েস স্যাʼর।" রিসিভার নামিয়ে রাখলেন অনঙ্গ। মিনিট পাঁচেক বাদেই ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটা তিন ডিজিটের নাম্বার ফুটে উঠলো, ʼজিরো জিরো এইট।ʼ অনঙ্গদেব পরক্ষণেই আরেকটা তিন ডিজিটের নম্বর প্রেস করলেন; সাথেসাথে মিরর ডোর খুলে গেলো দুভাগে, আর ঘরে এসে ঢুকলো যে যুবকটি; তার ছিপছিপে লম্বা চেহারা, চোখে ব্ল্যাক সানগ্লাস, পরণে ন্যানো মেটালে তৈরী ফুলস্লিভ ব্ল্যাক কস্টিউম, হাতে মেটালের গ্লাভস। গোঁফ দাড়ি কামানো, ব্যাকব্রাশ চুল, পায়ে হাঁটু অবধী জুতো। অনঙ্গদেব বললেন, "এসো ক্যাপ্টেন নীল। তোমার জন্য একটা কাজ আছে। দাঁড়িয়ে কেন? বোসো।" ক্যাপ্টেন মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে বললো, "বলুন স্যার, কি করতে হবে?" ফোল্ডিং চেয়ারে হেলান দিয়ে সোনার হোল্ডে সিগ্রেট ধরাতে ধরাতে অনঙ্গ বললেন, "গতকাল আমার বন্ধু প্রফেসর রোজ়ারিও আমাকে একটা অদ্ভুত ঘটনা মেল করে জানালো। আটলান্টিক মহাসাগরে একটা অদ্ভুত ঘটনা দুশো বছর ধরে ঘটে চলেছে; যার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা আজো পাওয়া যায়নি।" অনঙ্গদেব ক্যাপ্টেন নীলকে যা বললেন, তা আমরা আগেই শুনেছি প্রফেসর রোজারিওর মুখে। ক্যাপ্টেন সব শুনে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভেবে বললো, "আমি কি করবো বলুন?" অনঙ্গ বললেন, "তুমি কালই ইভনিং ফ্লাইটে এরিজ়োনা চলে যাও, ওখানে জাহাজঘাটায় হার্বার মাস্টারের কাছে খবর নাও কোন জাহাজ আটলান্টিকে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। যদি কেউ নিজস্ব বোট নিয়ে ওদিকে যায়, তাদের কাছে লিফট নেওয়া সবচেয়ে ভালো। যেমন মৎসজীবী বা ওইরকম কিছু; তোমার পরিচয় তুমি ফটোগ্রাফার, ফ্রিল্যান্স। এরিজোনার বিভিন্ন পত্রিকায় তোমার তোলা ফটো বেরোয়।" ক্যাপ্টেন নীল উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বললো, "ফটোটা এমনিতে খুব একটা খারাপ তুলিনা। ওকে স্যার, আই উইল ট্রাই মাই লেভেল বেস্ট।"

মেঘমুক্ত আকাশ, বেশ পরিষ্কার দিন। নির্বিঘ্ন ছন্দে আটলান্টিকের ঢেউয়ের ফেনা কেটে এগিয়ে যাচ্ছিলো ক্রুজ বা প্রাইভেট জাহাজটা। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন নীল; এই ক্রুজটা পশ্চিম সমুদ্রে কোনো এক্সপিডিশনে যাচ্ছিলো, নীলকে লিফ্ট দিয়েছেন কাপ্তান। নীল ডেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলো নীলচে ছাইরঙ মেশানো ঢেউগুলো ফেনা হয়ে আছড়ে পড়ছে জাহাজটার গায়ে, যেন ক্রুজটার পায়ে মাথা খুঁড়ছে ঢেউগুলো। মাথার ওপর কয়েকটা সীগাল ক্রমাগতই উড়ছে! নীলের পরিচয়, ও একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার; এরিজোনার বিখ্যাত দুটি পত্রিকায় ওর তোলা ফটো নিয়মিত ছাপা হয়। বলা বাহুল্য, গলায় ব্যান্ডে ঝোলানো ক্যাম আর পরণের ন্যানো মেটাল কস্টিউমের ওপর জ্যাকেট চাপাতে হয়েছে। তবুও হাতের মেটাল গ্লাভস আর সর্বক্ষণ চোখে সানগ্লাস দৃষ্টি আকর্ষণ করেই। অনঙ্গদেব বলেন, "চোখ মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়; সিক্রেট এজেন্টের উচিত সবসময় চোখ ঢেকে রাখা।" তাই তাঁর কথায় আত্মগোপন করেই আছে নীল। হঠাৎ পেছন থেকে একটা কন্ঠস্বরে চমক ভাঙলো নীলের, "হ্যাল্লো মি.নীল।" নীল পেছন ফিরে দেখলো এই জাহাজের ক্যাপ্টেন; প্রৌঢ় মানুষ, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, বেঁটে খাটো চেহারা, সোনালি চুল। ক্যাপ্টেন বললেন, "মি.নীল, আপনাকে আমাদের ক্রুজের মালিক ব্রেকফার্স্টে ইনভাইট করেছেন। আসুন প্লিজ!" নীল হেসে বললো, "ওঃ, শিওর; চলুন।" ব্রেকফার্স্ট টেবিলে তিনজনের সাথে দেখা হলো, ক্যাপ্টেন বললেন, "আলাপ করিয়ে দিই, ইনি এই ক্রুজের কমান্ডার ব্র্যান্ডন, আর ইনি ওঁর সহকারী এক্সেল। আর....ইনি হলেন ব্র্যান্ডনের বিশেষ বন্ধু ইয়ার হুসেন।" নীল দক্ষ চোখে জরিপ করছিল তিনজনকে। ব্র্যান্ডনের ছোটো খাটো একটা পাহাড়ের মতো চেহারা, ন্যাড়া মাথা, থুতনিতে চৌকোনা দাড়ি, কালো স্লিভলেস জ্যাকেট আর কালো ক্লথ প্যান্ট পরণে, পায়ে হাঁটু অবধী জুতো, আর একটা চোখ.....কালো কাপড়ে ঢাকা। ঈগল পাখির মতো তীক্ষ্ম এক চোখে লোকটা তাকিয়ে ছিলো নীলের দিকে। ব্র্যান্ডনের সহকারী লোকটা বেঁটে, রোগা, সেভাবে দৃষ্টি আকর্ষক চেহারা নয়। তবে ইয়ার হুসেনের চেহারা দেখলেই মনে হয় লোকটা ভয়ঙ্কর; সাদা লম্বা চুলগুলো মুখের ওপর এলোমেলো পড়ে আছে। রোগা, কিন্তু বোঝা যায় বেশ শক্তিশালি, লম্বা তালঢ্যাঙা শরীর, কালো কষ্টি পাথরের মতো শরীর, চওড়া সাদা গোঁফ, ক্রুর দুটো চোখ। সাদা স্লিভলেস গেঞ্জি আর নীল জিন্স পরণে। নীল তিনজনের সাথেই করমর্দন করলো; ব্র্যান্ডন বললো, "আলাপ করে খুশি হলাম, বসুন। হুইস্কি চলবে তো?" নীল একটা চেয়ার দখল করে মৃদু হেসে বললো, "না মি.ব্র্যান্ডন, আমার পানীয়টা একটু অন্য....দুধ।" ইয়ার হুসেন বিদ্রুপের ভঙ্গিতে হেসে বললেন, "দুধ? মজার লোক তো আপনি!" নীল একবার তাঁর দিকে চেয়ে ঠান্ডা স্বরে বললো, "আপনার মনে হয় যে দুধ খাওয়াটা মজার ব্যাপার?" ইয়ার হুসেন দুʼদিকে মাথা নেড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ব্র্যান্ডন দুʼবার তুড়ি দিয়ে চেঁচিয়ে বললো, "ওয়েটার, একগ্লাস দুধ...এখানে।" নীল বললো, "আপনার কি ধরণের এক্সপিডিশন মি. ব্র্যান্ডন?" ব্র্যান্ডন হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো, "পশ্চিম সমুদ্রের দিকের ছোটো ছোটো দ্বীপগুলোর বালিতে শোনা যায় সোনা মিশে থাকে, আমাদের এক্সপিডিশন সেটা খুঁজতেই।" নীল বললো, "যুগ যুগ ধরে বহু জায়গার বালিতেই শুনছি সোনা মিশে থাকে, কিন্তু বাস্তবে পাওয়া যায় কি?" ইয়ার হুসেন টেবিল চাপড়ে বললো, "আলবত্ যায়। আপনি জানেন, কতবার কত ভাগ্যান্বেষী কত সোনাবেলার বালিতে সোনা পেয়ে ধনী হয়ে গেছে?" নীল দুধের গ্লাসে ছোট চুমুক দিয়ে বললো, "কিন্তু মি. হুসেন, পৃথিবীতে সত্যিই এরকম জায়গা থাকলে রাতারাতি বহু মানুষ বড়লোক হয়ে যাবে.... তাইনা?" ইয়ার হুসেন একটা মোটা চুরুট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, "বেশির ভাগ মানুষ বোকা এই দুনিয়ায়....যদি সবাই বুদ্ধিমান হতো, তাহলে তো ইয়ার হোসেনের সাথে আর পাঁচজনের তফাৎ থাকতোনা।" নীল বললো, "বেশ, তবে কি জানেন মি. হুসেন? আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমিতে কোনো কোনো জায়গায় খুঁজলে বালির মধ্যে সোনা পাওয়া যায়, কিন্তু সারাদিন খুঁড়লে হয়তো এককণা সোনা পাওয়া যায়। সুতরাং......!" ব্র্যান্ডন এবার কঠিন স্বরে বললো, "আপনার বড় বেশি কৌতুহল মি. নীল, আপনি তো ফটো তুলতে এসেছেন! ফটো-টটো তুলুন, চলে যান। এসব ব্যাপারে নাক গলানোর কি প্রয়োজন?" নীল মৃদু হেসে দুধের গ্লাসে চুমুক দিতে যাচ্ছিলো, হঠাৎ একটা জিনিষ দেখে চমকে উঠলো.....! ব্র্যান্ডনের হাতের কবজির নীচে একটা ট্যাটু......একটা গোল বৃত্তকে ঘিরে পাঁচটা ছোটো সার্কল। ওই ট্যাটুটা তো ওর পরিচিত...ওটাতো সিং জলদস্যুদের চিহ্ন!

সমুদ্রে সন্ধ্যা আগত; জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে নীল ভাবছিলো ঈউনিকর্ণের ব্যাপারে। হিসেবমতো এরিজোনা জাহাজঘাটা থেকে গ্রিনিচ মধ্যরেখা ধরে বর্তমান জলস্থানের কাছাকাছির মধ্যেই আগের দুʼটো জাহাজ হারিয়ে গেছিলো। ডেকের ওপর একটা চেয়ারে বসে একটা কাগজের ওপর এই ভৌগোলিক হিসেবটা করছিলো ও; আর মাঝে মাঝে দুরবীন চোখে লাগিয়ে এদিক ওদিক দেখছিলো। পশ্চিম আকাশে কোনো এক অদৃশ্য ঐন্দ্রজালিক যেন অজস্র রঙের চ্ছটা ছড়িয়ে দিয়েছেন, লাল আর হলুদে যেন রঙ্গোলি চলছে; আর তার চারপাশে বেগুনি, নীল, লাল মেঘ গুলো বিভিন্ন আকার নিয়ে ঘনীভুত হচ্ছিলো, আর ঢলে পরা সুর্যের লাল কিরণ তেরচা হয়ে পড়ে সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে যেন অজস্র সোনা হীরে মুক্তো অবহেলায় ছড়িয়ে দিয়েছে কেউ আকাশ থেকে। নীলের কাঁধে হঠাৎ একটা শক্ত হাতের চাপড় মারলো পেছন থেকে কেউ, "কি ফটোগ্রাফার মশাই?" নীল পেছন ফিরে চেয়ে দেখলো, ব্র্যান্ডন। ও বললো, "হুম, গুড ইভনিং।" ব্র্যান্ডন চটুল হেসে বললো, "আপনি  ফটো তোলা ছেড়ে  চোখে দুরবীন লাগিয়ে অত কি দেখেন ফটোগ্রাফার মশাই? আর এসব হিসেব নিকেশই বা কিসের?" নীল ব্যঙ্গটা অগ্রাহ্য করেই স্মিত হেসে বললো, "দেখছি, দুʼএকটা হাঙরের দেখা পাই কিনা। হিসেব মতো এদিকের সমুদ্রে খুব হাঙর।" ব্র্যান্ডন চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, "হাঙর দেখার খুব শখ বুঝি? বড় ভয়ানক প্রাণী, ওদের মুখে পড়লে বাঁচা খুব কষ্টকর। দেখবেন; একটু সাবধানে থাকবেন! বলা তো যায়না।" কথাটা যে তীব্র শ্লেষ আর হুমকি মেশানো সেটা বুঝতেই পারলো নীল। উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন হেসে বললো, "আপনার চিন্তা নেই মি. ব্র্যান্ডন, বিপদ নিয়ে খেলতে বেশ ভালো লাগে আমার। হাঙরের মুখে পড়লেও আত্মরক্ষা করতে আমি জানি!" ব্র্যান্ডনের ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো, নীলের কাঁধ চাপড়ে বললো, "ভালো ভালো, বেশ ভালো। আচ্ছা আসি।" হনহন করে হেঁটে নিচের কেবিনে চলে গেলো ও; নীলের ভ্রু আপনা থেকেই কুঁচকে গেলো। এদের সন্দেহ হয়েছে, আরো সতর্ক হতে হবে! আর বলা বাহুল্য, যে এরা মোটেও সুবিধের লোক নয়। কিন্তু এরা আসলে কী? নীল দুʼদিকে মাথা নাড়লো, নাঃ! পরিবেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই।

মাঝরাতে জাহাজটা হঠাৎ সজোরে দুলতে শুরু করলো। তার সাথে প্রচন্ড চিৎকার চেঁচামেচি, এক একবার মনে হচ্ছে জাহাজটা এক্ষুণি উলটে যাবে; ডুবে যাবে সমুদ্রে! কেবিনের ভেতর সচমকে ঘুম ভেঙে উঠে বসলো নীল, কেবিন থেকে ছিটকে পড়ে যাবে বুঝি এক্ষুণি। কি হলো হঠাৎ? ঝড়? দুর্যোগ? নীল কস্টিউমের ওপর একটা জ্যাকেট চাপিয়ে ছুটে বেড়িয়ে এলো ডেকে, সেখানে এখন সব্বাই জড়ো হয়েছে। ভয়ে, আতঙ্কে আর্তনাদ করছে সবাই; খালাসিরা বার বার বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকছে! এক একটা ঢেউয়ের ধাক্কায় উলটে আসছে জাহাজটা, সবাই কোনোভাবে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়ার হুসেনের সাদা চুলগুলো উড়ছে পাগলাটে হাওয়ায়, কাঁপা গলায় চিৎকার করছেন তিনি, "হা আল্লাহ....! হে পয়ভর দিগারে আলম! দোয়া করো আল্লা; দোয়া করো। হা আল্লাহ বিসমিল্লা...রহিম!" সমুদ্রের গর্জন, ঝড়ের শব্দে কন্ঠস্বর চাপা পড়ে যায়। কিন্তু নীল তীক্ষ্ম চোখে জরিপ করে চমকে উঠলো! আকাশে গোল চাঁদ, মেঘমুক্ত আকাশ, আর দুরের সমুদ্র শান্ত। তবে কিসের এই দুর্যোগ? নীল চিৎকার করে বললো, "ব্র্যান্ডন, এ-সব কি হচ্ছে?" ঝড়ের ঝাপটায় কথা আটকে যাচ্ছিলো মুখের! ব্র্যান্ডন মাস্তলটা ধরে কোনো ভাবে স্থির হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলো, ও চেঁচিয়ে বললো, "জা-জ্জানিনা মি.নীল! তবে জাহাজ কাপ্তেনের হাতছাড়া হয়ে গেছে।" নীলের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো; হাতছাড়া...মানে? কোনো এক অদৃশ্য শক্তি কি তবে টানছে জাহাজটাকে? অপার্থিব শক্তি? চোখে দুরবীন লাগিয়ে ক্যাপ্টেন দূরে কিছু দেখার চেষ্টা করছিলেন, হঠাৎ চরম আতঙ্কের স্বরে চিৎকার করলেন, "দুরে একটা ডুবো পাহাড়ের মতো কিছু দেখা যাচ্ছে, আর....আমাদের ক্রুজ়টা ওদিকেই এগোচ্ছে!" খালাসিরা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো; নীল ক্যাপ্টেনের হাত থেকে দুরবীনটা নিয়ে নিজে দেখলো। হ্যাঁ, একটা কিছু দেখা যাচ্ছে বটে! অন্ধকার সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে কিছু একটা ; তবে ডুবোপাহাড় নয়! ওটা....একটা জাহাজ। জাহাজটা স্থির দাঁড়িয়ে আছে! ব্র্যান্ডন পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়ে বললো, "কাপ্তান....! কিছু করো কাপ্তান!" এক একটা বড় ঢেউ এসে সকলকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে একেকবার। ক্যাপ্টেন মাথার চুল মুঠো করে ধরে চেঁচালো, "কি করবো চিফ? কি করবো আমি?? ক্রুজ় অন্য কোনো অদৃশ্য শক্তি চালিত করছে।" জাহাজটা ততক্ষণে ঢেউয়ের এক একটা সজোর ধাক্কায় ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে দুরের জাহাজটার, দূরত্ব ক্রমেই কমছে। ক্যাপ্টেন পাগলের মতো নিজের কেবিনে গিয়ে হুইল ঘোরাতে লাগলো সজোরে...কিন্তু বিধি বাম ; জাহাজের নিয়ন্ত্রণ এখন কোনো অপার্থিব শক্তির হাতে। দেখতে দেখতে জাহাজটা এসে পড়লো ওই জাহাজটার কাছে; আর বোঝা গেল এটা একটা প্রাচিনকালের পালতোলা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। আর সাথে সাথেই এতো দুর্যোগ, এতো ঝড়, ঝঞ্ঝা সব....একনিমেষে থেমে গেলো। সমুদ্র একেবারে শান্ত! অবাক বিস্ময়ে সবাই ডেকে ছুটে এলো; একি অদ্ভুত ঘটনা? পূর্ণিমা চাঁদের আলো সরাসরি পড়েছে ওই ধ্বংসাবশেষের ওপর, আর তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জাহাজের গায়ে খোদাই করে ডাচ ভাষায় লেখা ʼঈউনিকর্ণ।ʼ নীল চমকে উঠলো; ওর যাত্রা তবে সফল? কিন্তু ও তো নিজে আসেনি, বরং ঈউনিকর্ণ নিজেই টেনে এনেছে! তবে এর চেয়েও বড় চমক অপেক্ষা করছিল ওর জন্য; সহসা খালাসিরা চিৎকার করে উঠলো উল্লাসের স্বরে, "ঈউনিকর্ণ! ঈউনিকর্ণ!" ব্র্যান্ডন আর ইয়ার হোসেন ছুটে এলো ডেকের ধারে, নীল অবাক বিস্ময়ে দেখলো, ওদের দুʼজনের চোখে মুখে পৈশাচিক একটা উল্লাস! ব্র্যান্ডন চিৎকার করলো, "ইউরেকা! ঈশ্বর নিজে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন এখানে, চলো! বোট নামাও, এক্ষুণি।" নীল বুঝতে পারছিলো, এদের অভিসন্ধি অন্য কিছু ; আর এটাও বেশ বুঝছিলো এবার ওকে নিজে থেকে পোজিশন নিতে হবে, নইলে সমূহ বিপদ আসন্ন, আর আত্মগোপন করা অসম্ভব। ও ছুটে এসে ব্র্যান্ডনকে বললো, "কি ব্যাপার বলুনতো? এসবের মানে কি?" ইয়ার হোসেনই ব্র্যান্ডনের বদলে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, "মি. ফটোগ্রাফার, আপনি কেবিনে যান। আমাদের ব্যাপারে নাক গলানোর প্রয়োজন নেই!" নীল বজ্র কঠিন স্বরে বললো, "মানে? আপনারা আসলে কে? কি করতে চান? এই জাহাজের ধ্বংসাবশেষই বা কিসের?" ব্র্যান্ডন এবার সরাসরি কোমরের কাছ থেকে একটা রিভলবার বের করে নীলের কপালে ঠেকিয়ে বললো, "আমাদের ব্যাপারে নাক গলাসনা ফটোগ্রাফার, তার ফল খুব ভালো হবেনা; ভদ্র ভাবে বলছি কেবিনে চলে যা।" ক্যাপ্টেন নীল নিজের কস্টিউমের ওপর থেকে জ্যাকেটটা খুলে ফেলে আলতো হেসে বললো, "আর লুকিয়ে লাভ নেই ব্র্যান্ডন, তোমাদের পরিচয় আমি অনেক আগেই বুঝে গেছি। তুমি আর ইয়ার হোসেন সিং জলদস্যু; প্রথম দিন তোমার হাতের উল্কি দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো। তারপর আজ সন্ধ্যায় আমি লুকিয়ে নিচের কেবিনে ঢুকে প্রচুর আর্মস পেয়েছি।সোনাবেলা মিথ্যা গল্প!" ইয়ার হোসেন এবার চটুল হেসে বললো, "তোমার হাঙড়ের ফটো তোলাও মিথ্যা গল্প। আমারও প্রথম দিন থেকেই তোমায় সন্দেহ হয়েছিলো, তুমি টিকটিকি। কিন্তু ওহে, তোমার মতো খুদে টিকটিকি কে শায়েস্তা করতে আমার জাস্ট দুʼমিনিট লাগবে। সানতিনি, এক্সেল! ওর হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধো।" তিনজন খালাসি এগিয়ে এলো নীলের দিকে, কিন্তু নীলকে ওরা চেনেনা ; বিদ্যুৎ গতিতে লাফ কেটে ও সবুট এক লাথি মারলো একজনের মুখে, আরেকজনের চোয়ালে সজোরে লৌহ মুষ্টির আঘাত। এক্সেলের ঘাড় মেটালের হাতের চাপড়ে বেঁকে গেলো বোধহয়! ব্র্যান্ডন একটা লাফ দিয়ে স্প্রিং এর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো নীলের ওপর, নীল সাথে সাথে ন্যানো টেকনোলজি গ্লাভস থেকে ২৫০ ভোল্ট রে ছাড়লো ব্র্যান্ডনের ওপর, ব্র্যান্ডন গুলি খাওয়া চড়ুইপাখির মতো ছিটকে পড়লো মাটিতে, সারা শরীরটা কেঁপে উঠলো ওর। নীল বুঝতে পারছিলনা ওর কি করা উচিত, সামনে রাইফেল উঁচিয়ে পাঁচ-ছয়জন সিং জলদস্যু; আর পাশে ইয়ার হোসেন। ও জানে, ওর মেটাল কস্টিউম ভেদ করতে পারবেনা বুলেট, কিন্তু এতোজন বন্দুকধারীর সাথে একা পেরে ওঠা....! ইয়ার হোসেন একটা মোটা চুরুটে কড়া ধোঁয়া ছেড়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বললো, "বাঃ, টিকটিকির এলেম আছে বলতে হবে, হ্যাঁ? কিন্তু আমাদের পেছনে লেগে এই জাহাজে তো এসেছো,কিন্তু ফিরবে কীকরে হে?" নীল মৃদু হেসে বললো, "আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলি, আমি অন্য একটা রহস্য সমাধানের জন্য এখানে এসেছি; আপনাদের সাথে যোগাযোগটা নেহাতই কাকতালীয়। আর দ্বিতীয়ত, একবার আমার ন্যানো টেকনোলজির পাওয়ার দেখেও কি বুঝতে পারেননি আমার ক্ষমতা....?" ইয়ার হোসেন ওর কপালে রিভলবার ঠেকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, "যদি মেরে এই সমুদ্রে তোমার লাশটা ভাসিয়ে দিই.....কিছু করতে পারবে? আমি ইয়ার হুসেন, এই জাহাজের কমান্ডার ব্ল্যাকহোল ব্র্যান্ডনের জিগরি দোস্ত; এই হাতে বাইশটা মার্ডার করেছি, কিন্তু...." কথাটা শেষ করলেননা ইয়ার হোসেন, নীলের মাথায় পেছন থেকে একটা শক্ত আঘাত লাগলো, ও অজ্ঞান হলোনা বটে; কিন্তু আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। পেছনে দাঁড়িয়ে ʼহাঃ হাঃʼ করে হাসছে ব্র্যান্ডন, বন্দুকের কুঁদোর ঘা। ইয়ার হোসেন চুরুটে লম্বা টান দিয়ে কথাটা শেষ করলো, "...তোমার জন্য অন্য ব্যবস্থা!" ব্র্যান্ডন হিসহিসে গলায় বললো, "হাঙর দেখার খুব শখ হয়েছিল না? হাঙরের সাথেই দেখা হবে!" এক্সেল নীলের হাতদুটো শক্ত করে বেঁধে দিলো দড়িতে। নীলের জ্ঞান থাকলেও মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, তাই বাধা দেওয়ার চেষ্টাও করলোনা। চারজন বলিষ্ঠ মানুষ ধরাশায়ী নীলের শরীরটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো সমুদ্রে।

সমুদ্রে পড়েই নীলের মনে হলো ও আর বাঁচবেনা। চারদিকে সবুজ অন্ধকার, সেভাবে কিছু দেখা যায়না। প্রথমে চোখ দুটো বুজে ফেলেছিলো নীল, ওর মনে হলো এই ওর শেষ মুহূর্ত; এখান থেকে বেঁচে ফেরা এককথায় অসম্ভব। একফোঁটা দমের জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো ওর, নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিলো শরীর। "তবে কি পারবোনা আর ঈউনিকর্ণের রহস্য সমাধান করতে? পারবোনা ফিরে যেতে অনঙ্গস্যারের কাছে....?" নীলের শরীরের সমস্ত রক্ত যেন ছলকে উঠে বিদ্রোহ করে উঠলো; না! না! না! কক্ষণো না! ওই শয়তান গুলোকে উচিত শিক্ষা দেওয়া বাকি আছে; কিন্তু কীইবা করবে ও? নীলের এতক্ষণে মনে পড়লো ওর ন্যানো টেকনোলজির গ্লাভসের কথা, বাঁধা হাতের দড়ির ওপর ক্রমাগত শক দিতে লাগলো ও। ভেজা দড়ি....মিনিট খানেকের মধ্যেই কেটে গেলো হাত থেকে; দ্রুত সাঁতার কাটতে শুরু করলো নীল। দম ফুরিয়ে আসছে, আর বেশিক্ষণ পারা যাবেনা! কিন্তু....বিপদের এখনো অনেক বাকি ছিলো। সাঁতরে পিছন ফিরেই চমকে উঠলো ও; একটা আতঙ্কের হিমস্রোত শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো যেন! মাত্র দশহাত দুরে ও কিসের বিভীষণ মূর্তি? সাক্ষাৎ মৃত্যুদুত....বিশাল চেহারার একটা হাঙর! আরো ভয়ের কথা....দানবটা দেখতে পেয়েছে নীলʼকে ; ঘোলাটে হলুদ চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে। আর প্রাণীটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ওর দিকে...! বাঁচার সব পথই এবার বন্ধ হলো তবে? নীলের একটা বড় গুণ, ও চিরদিনই বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। বিদ্যুৎ গতিতে কোমরবন্ধ থেকে লম্বা ঝকঝকে একটা ছুরি বের করলো নীল, ঝুঁকি একটা নিতেই হবে ; যদিও এতে মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রবল! কিন্তু.....এমনিতেও তো বাঁচার সম্ভাবনা কম। নীল পাগলের মতো সাঁতরে হাঙরটার পাশ কাটিয়ে পেছন দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলো; কিন্তু প্রাণীটা ওর বিশাল লেজ আছড়ে নীলকে ছিটকে দিলো দুʼহাত দুরে। নীলের হাত থেকে ছুরিটা ছিটকে গিয়ে পড়লো একটু দুরে। আর দম রাখা অসম্ভব! ওর মনে হচ্ছে বুকের ওপর যেন সাতমণ পাথর চাপিয়ে দিচ্ছে কেউ; আর পারা যাচ্ছেনা, হাঙর ওকে খেলে খাক, ওর নিস্তেজ শরীরটা ধীরে ধীরে সাদা বালির ওপর ঢলে পড়ছে ; এ যেন এক আলাদা জগৎ, পরিচিত জগতের সাথে কোনো মিল নেই! সাদা বালির ওপর খেলে বেড়াচ্ছে অসংখ্য শামুক ঝিনুক, মাথা তুলে আছে অচেনা সব উদ্ভিদ; লাল নীল সবুজ বেগুনি কত রকম ছোটো বড় পাথর ছড়িয়ে আছে। এই তবে মৃত্যু? আর খুব দুরে নেই.....ওর থেকে! ওই তো এসে গেছে বিশাল দানবটা ; লাল টকটকে জিভ, সাজানো ছুরির মতো দাঁত। হঠাৎ শরীরে যেন শেষবারের মতো অসুর শক্তি ভর করলো নীলের, হাতের ন্যানো দস্তানার তর্জনি থেকে বেড়িয়ে এলো নখের মতো সুতীক্ষ্ম সূঁচালো মেটাল পিন।সমস্ত শক্তি একজোট করে হাঙরটার দুটো চোখে দুটো হাতের দুই তর্জনি গেঁথে দিলো ও! জল তোলপাড় করে সরে গেলো অন্ধ দানবটা ; দুটো চোখের রক্তে লাল হয়ে গেলো চারদিক। দ্রুত সাঁতরে সমুদ্রের ওপরে মাথা তুলে বুক ভরে একবার দম নিলো নীল।

লাইফবোটে ওঠার সাথে সাথেই আবার শুরু হলো সেই প্রলয়ঙ্কর ঝড়। সমুদ্র ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো উত্তাল হয়ে উঠলো, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যেন বোটটা এদিক ওদিক টাল খেতে লাগলো! ইয়ার হোসেন পাগলের মতো চিৎকার করে বললো, "শুভ নয়! এ লক্ষণ শুভ নয়! ফিরে চলো ব্র্যান্ডন....ঈউনিকর্ণ অশুভ!" ব্র্যান্ডন বললো, "অসম্ভব! বোট আমাদের আয়ত্তে আর নেই; নিজের গতিতে চলছে!" এক্সেল প্রবল ভয় পাওয়া গলায় মোজেসের বাণী বিড়বিড় করছিলো, হাওয়া আর ঢেউয়ের ধাক্কায় কথা কেটে যাচ্ছে। একেকটা বিরাট ঢেউ প্রায় তিন-চার ফুট লাফিয়ে উঠছে; ব্র্যান্ডন হাঁফাচ্ছিলো ক্রমাগত, কাটা কাটা স্বরে বললো, "ইয়ার হোসেন, এসবের মানে কি? তুমি বলছো অলৌকিক, আর আমার মনে হয় স্বয়ং ঈশ্বর আমাদের এভাবে ঈউনিকর্ণের কাছে পৌঁছে দিলেন। আমাদের উদ্দেশ্য তো এটাই ছিলো, ঈউনিকর্ণের খাজ়ানা লুট করা!" ইয়ার হোসেন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনি দশ বারো হাত দুরে প্রবল শব্দ হয়ে ওঁদের ক্রুজটা বিস্ফোরণ হলো। প্রবল আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো বোটের ছʼজনেই, একি অলৌকিক কান্ড? ব্র্যান্ডন হাত পা ছুঁড়ে পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলো, "এক্সেল.....এক্সেল! আমার জাহাজ......! বাইশজন খালাসি....বন্দুক, রিভলবার, খাজানা.......সব শেষ!! শেষ!! উউউউফ!" ইয়ার হোসেন মাথার চুল খামচে বললো, "হা খুদা! এবার আমরা ফিরবো কিকরে? স---ব শেষ!" দুʼজন খালাসি বললো, "চিফ....এ-এসব ভূ-ভ্ভূতুড়ে কান্ড!" ততক্ষণে বোট থমকে গিয়েছে ঈউনিকর্ণের ধ্বংসাবশেষের সামনে, ব্র্যান্ডন উঠে দাঁড়িয়ে বললো, "এসব কিছু পরে ভাবা যাবে। আপাতত চলো ঈউনিকর্ণের ভেতরে ; এক্ষুণি!" খালাসি তিনজন হাতজোড় করে বললো, "মাপ করুন চিফ,কিন্তু আমরা যেতে পারবোনা!" ব্র্যান্ডন ভ্রু কুঁচকে বললো, "যাবেনা.....মানে? কেন যাবেনা?" এক্সেল বললো, "চিফ...এতোকিছু ভূতুড়ে কান্ডর পর আমরা আর....ওখানে যেতে চাইনা!" ইয়ার হোসেন আঙুল উঁচিয়ে বললো, "একটা টাকাও পাবেনা তোমরা!খাজ়ানার....বখরা চাইনা? একটা টাকাও দেবোনা।" খালাসিদের একজন বললো, "বেঁচে ফিরলে তবে তো খাজ়ানা হুজুর; আমাদের দরকার নেই খাজ়ানার...! আমরা বেঁচে ফিরতে চাই।" চারজনেই বুকে ক্রুশ আঁকলো ভয়ে ভয়ে। ব্র্যান্ডন চাপা হিসহিসে গলায় বললো, "চলো ইয়ার হোসেন; আর অপেক্ষা করতে চাইনা আমি!" বোটের সাথে একগাছা মোটা দড়ি শক্ত করে বেঁধে অন্য দিক ফাঁস লাগিয়ে ব্র্যান্ডনরা ছুঁড়ে দিলো ধ্বংসাবশেষে ওপর। ঝড়ের উত্তাল দাপটে কেঁপে উঠলো বোটটা, প্রবল ঢেউ উপেক্ষা করে দড়ি ধরে লাফ দিলো ইয়ার হুসেন আর ব্র্যান্ডন; একেবারে ধ্বংস জাহাজের ডেকে গিয়ে পড়লো। সাথে সাথেই ঘটলো আরেক ভয়ানক কান্ড! একটা প্রবল ঢেউয়ের ধাক্কায় দড়িটা ছিঁড়ে গেলো, আর ঘুর্ণিপাক দিতে দিতে তিনজন খালাসি আর এক্সেলকে নিয়ে বোটটা উল্টে গেলো উন্মত্ত সমুদ্রের বুকে। তাদের পাগলের মতো হাত-পা ছোঁড়া আর চিৎকারও ঢাকা পড়ে গেলো ওই উন্মাদ ঝড় আর সমুদ্রের গর্জনের শব্দে। ইয়ার হোসেন আর ব্র্যান্ডন হতবুদ্ধি হয়ে চিৎকার করে উঠলো ঈউনিকর্ণের ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে! ব্র্যান্ডন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো ওখানেই, ফিসফিস করে বললো, "শেষ......সব শেষ!" ইয়ার হোসেন মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে বললো, "কিচ্ছু শেষ নয়; আপাতত আমরা ঈউনিকর্ণের ডেকে আছি, আজ না হলেও কাল নিশ্চয়ই কোনো জেলে নৌকা বা জাহাজ যাবে এই পথে; তারা নিশ্চয়ই সাহায্য করবে আমাদের। ওঠো ব্র্যান্ডন, ওঠো!" ব্র্যান্ডন বললো, "কিন্তু আমার লোকজন, অস্ত্র??লুট করা সম্পদ? সব তো গেলো ইয়ার হোসেন।" ইয়ার হোসেন ঠোঁটের কোণে একচিলতে হেসে বললো, "কিন্তু....খাজ়ানা! ঈউনিকর্ণের খাজ়ানা তো আছে এখনো। চলো...খুঁজে দেখি! এখনো সব শেষ হয়নি!" ব্র্যান্ডনের চোখ দুটো চক্ চক্ করে উঠলো, উঠে দাঁড়িয়ে বললো, "চলো....চলো তবে!" ইয়ার হুসেন কোমরের কাছ থেকে একটা লম্বাটে সরু পাঁচসেলের টর্চ বের করে জ্বেলে বললো, "চলো ব্র্যান্ডন!" ভাঙাচোরা কাঠের ডেকে পা ফেলে এগিয়ে চললো দুʼজনে, অদ্ভুত ব্যাপার উত্তাল সমুদ্রে এতো বিরাট বিরাট ঢেউ আর ঝড়ের মধ্যেও এই কবেকার জাহাজের ধ্বংসাবশেষ অটুট দাঁড়িয়ে আছে ; একফোঁটাও নড়ছেনা। কখন যে আকাশের পূর্ণিমার চাঁদ মেঘের আড়ালে ডুবেছে ওরা দেখতে পায়নি, হঠাৎ আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অবধী বিদ্যুতের বেগুনি শিরা উপশিরা খেলে গেলো, আর সাথে সাথেই প্রবল ঝড়ের সাথে এবার বড় বড় ফোঁটায় নামলো বৃষ্টি। ইয়ার  হোসেন নিচের ভগ্ন কেবিনের দিকে টর্চ ফেলে বললো, "ব্র্যান্ডন, চলো। এখানে তো কিছুই নেই, নীচে যাই।" এলোমেলো ঝড়ে বৃষ্টি ফোঁটা গুলো চারদিকে ছড়াচ্ছিল; কাঠের ভাঙাচোরা সিঁড়িতে পা দিয়ে নিচে নামতে শুরু করলো দুজনে। সামনে ইয়ার হোসেন টর্চ হাতে, পেছনে ব্র্যান্ডন রিভলবার নিয়ে। নিচের ধাপে পা রেখেই চমকে উঠলো ইয়ার হোসেন; শক্ত কিসের ওপর পা পড়লো ওর? আরেকটু হলেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতো ও, টর্চ ফেলে দুজনেই আঁতকে উঠলো এবার ; একটা নরকঙ্কাল পড়ে রয়েছে কাঠের মেঝেতে। ব্র্যান্ডন ঢোঁক গিলে বললো, "মনে হচ্ছে.....এটা কোনো খালাসির কঙ্কাল এই জাহাজের; বহুদিনের!" ইয়ার হোসেন কেবিনের চারপাশে টর্চের রশ্মি ঘুরিয়ে অবাক হয়ে গেলো! চারপাশে সারী সারী কাঠের, লোহার সিন্দুক ; মেঝেতে পড়ে থাকা জীর্ণ মরচে ধরা তলোয়ার, আর.....তিন চারটি কঙ্কাল এদিক ওদিকে। ব্র্যান্ডনের চোখ দুটো পাশবিক উল্লাসে জ্বলে উঠলো, ও চিৎকার করে বললো, "ইয়ার হুসেন; আর দেরী নয়! চলো...ওইতো সিন্দুক! কতো সিন্দুক! খাজ়ানা...খাজ়ানা!!" ইয়ার হোসেন কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু হঠাৎ কেবিনের একদিকে একটা লম্বা ছায়ামূর্তি দেখতে পেলো ও; আর সাথে সাথেই প্রবল আতঙ্কে বাহ্যজ্ঞানরহিত হয়ে একটা প্রবল আর্তনাদ করে উঠলো। অন্ধকারের মধ্যে কে ওই ছায়ামুর্তি? কালো সিল্যুয়েট...আগন্তক! ব্র্যান্ডন কাঁপা কাঁপা স্বরে চিৎকার করে উঠলো, "ইয়ার হো-হোসেন-ন্ন....!টর্চ ফেলো......জলদি!!" ইয়ার হোসেন ভুলে গিয়েছিলো টর্চের কথা; মনে পড়তেই সোজা তুলে ধরলো আগন্ত্তকের ওপর। দেখা গেলো.....আপাদমস্তক ভিজে শরীরে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন নীল, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। ইয়ার চিৎকার করে উঠলো, "এ...এক্কি? তু-ত্তুমি!" ব্র্যান্ডন দুʼপা পিছিয়ে এসে ঢোঁক গিলে বললো, "তুমি....বেঁচে আ..আছো?" নীল ফিসফিস করে বললো, "তাইতো মনে হয়; কিন্তু তোমরা বাঁচবে তো?" স্প্রিং এর মতো লাফিয়ে উঠে ও সবুট একটা লাথি মারলো ব্র্যান্ডনের রিভলবার ধরা হাতে, রিভলবারটা ছিটকে গিয়ে পড়লো মেঝেতে; ইয়ার হোসেন বেল্টের কাছে লেদারের খাপ থেকে রিভলবার টেনে বের করতে যাচ্ছিলো, নীল ওর হাতের ন্যানো গ্লাভস থেকে মেটাল বুলেট ছুঁড়ে দিলো ইয়ার হুসেনের দিকে! বলা বাহুল্য; এটা শুধু আহত করার জন্যই ছোঁড়া, অব্যর্থ লক্ষ্য! কাঁধে লাগলো গুলিটা,ইয়ার হোসেন হাত দিয়ে কাঁধ চেপে ধরে বসে পড়লো মেঝেতে। ব্র্যান্ডন লাফ কেটে বেঁজির মতো ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো নীলের ওপর, নীল ব্র্যান্ডনের বিশাল শরীরটার ভার সহ্য করতে না পেরে পড়ে গেলো মেঝেতে ; দুজনেই গোরিলার মতো জড়াজড়ি করে গড়াচ্ছিল মেঝেতে। নীল হঠাৎ ডানহাঁটু ভাঁজ করে দ্রুত লাথি চালিয়ে দিলো ব্র্যান্ডনের তলপেটে, গুলি খাওয়া চড়ুই পাখির মতো ব্র্যান্ডন ছিটকে গিয়ে পড়লো একটু দূরে ; মুখ দিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ বেড়িয়ে এলো ওর। নীল তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গিয়ে ওর লৌহমুষ্টির আঘাত হানলো ব্র্যান্ডনের চোয়ালে, ব্র্যান্ডনের ঠোঁটের কোণ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লো। নীল হিসহিসে গলায় বললো, "দ্যাখো ব্র্যান্ডন, কার সাথে লড়তে এসেছিলে!" ততক্ষণাৎ পেছনে কাঁধের দিক থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলো দুটো বজ্রকঠিন হাত, নীল কিছু করার আগেই ওর লম্বা ছʼফিটের শরীরটাকে ছিটকে ফেলে দিলো মেঝেতে ; নীল মাথা তুলে দেখলো ইয়ার হোসেন। ও দাঁতে দাঁত চেপে বললো, "ক্যাপ্টেন নীল কারোর ঋণ রাখেনা ইয়ার হুসেন, খুব ভুল করলে!" একটা ছোটো ডিগবাজি খেয়ে নীল ইয়ার হোসেনের থুতনিতে সবুট লাথি মেরে ওকে ছিটকে ফেলে দিলো মাটিতে; পরক্ষণেই কোমরের লেদার খাপ থেকে রিভলবার বের করে উঠে দাঁড়ালো ও। নীলের দিকে চেয়ে ঠোঁটের কোণে আলতো হেসে সাপখেলানো সুরে বললো, "এবার? হাত তোলো টিকটিকি; আর তো বাঁচার উপায় নেই!" নীল কিছু করার আগেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার শুরু হলো, যাতে নীলের সাথে সাথে ব্র্যান্ডন আর ইয়ার হোসেনও চমকে উঠলো। একটা মৃদু শব্দ, ঘসঘস করে হচ্ছে এই কেবিনের মধ্যেই ; ঠিক যেন কাঠের দেওয়ালে কিছু ঘষার শব্দ! ব্র্যান্ডন দ্রুত মাটি থেকে টর্চটা তুলে কাঁপা হাতে জ্বেলে চারদিকের দেওয়ালে ঘোরাতে লাগলো; সহসা পশ্চিমের দেওয়ালে আলো পড়তে একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে তিনজনেই আঁতকে উঠলো। কাঠের দেওয়ালের গায়ে তাজা রক্তে আপনা থেকেই ফুটে উঠছে লেখা, ঠিক যেন কেউ আঙুল দিয়ে লিখছে ঘেঁষটে ঘেঁষটে, মোটা হরফে ফুটে উঠলো ধীরে ধীরে, ʼDANGER'! নীল বেশ বুঝছিলো এইসব কিছু......অতিপ্রাকৃত, পৈশাচিক। কি হবে এরপরে? কি হবে?? নীল কখনো এতটা ভয় পেয়ে যায়নি বড় বড় বিপদের মুখেও, কিন্তু যে শত্রু অজ্ঞাত, যাকে ধরা ছোঁয়া যায়না, তার সাথে মোকাবিলা করা তো....অসম্ভব! ব্র্যান্ডন হঠাৎ উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠলো, "ইয়ার হোসেন....আর দেরী নয়; চলো....কাম অন!" বলতে বলতে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়লো সিন্দুকের ওপর, পাগলের মতো বহুদিনের মরচে ধরা সিন্দুকগুলো খোলার চেষ্টা করলো; কিন্তু প্রায় তিনশো বছরের বন্ধ বাক্স গুলো জ্যাম হয়ে আছে, খুললোনা সহজে! পাগলের মতো বুকে চাপড় মেরে চেঁচিয়ে উঠলো ব্র্যান্ডন, "খুলছেনা কেন?? কেন? কেন?" ইয়ার হোসেন ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো ওর পাশে, উত্তেজিত গলায় বললো, "ব্র্যান্ডন, শান্ত হও....প্লিজ়! ভুলে যেওনা...আমরা যেখানে আছি সেই জায়গাটা প্রেতপুরীর সমান।" ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ব্র্যান্ডন, এ সম্পুর্ণ অন্য মানুষের দৃষ্টি; অসংলগ্ন দৃষ্টি। ব্র্যান্ডন দাঁত কিড়মিড় করে বললো, "এই...আসবিনা! খবর্দ্দার আসবিনা এদিকে! এসব...এসব খাজ়ানা আমার; হ্যাঁ! আমার! আমার!" শেষের কথাটা বলার সময় গরিলার মতো বুকে চাপড় মারলো ও। ইয়ার হোসেন ঢোঁক গিলে ব্র্যান্ডনের একটা হাত ধরে বললো, "এ...সব কি বলছো তুমি ব্র্যান্ডন? আমরা দুʼজনে শুধু এই খাজ়ানার জন্য এতদূর ছুটে এসেছি, ভুলে গেলে?" ব্র্যান্ডন হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে একটা জান্তব গর্জন করে বললো, "নাঃ! এ খাজানা কারোর না! এ শুধু আমার...আমার।" ইয়ার হোসেন এবার ধমকের স্বরে বললো, "ব্র্যান্ডন! পাগল হয়ে গেছো তুমি....? না না! আমি অত বোকা নয়, পাগল সেজে আমাকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা কোরোনা! ইয়ার হোসেনের সাথে বেইমানি করে কেউ আজ অবধি পার পায়নি.....ইনশাল্লাহ!" ইয়ার হোসেনের সাথে সাথে নীলকেও চমকে দিয়ে ব্র্যান্ডন হঠাৎ কোমরের ব্যান্ড থেকে একটা বেঁটে রিভলবার বের করে ঈগলের মতো একটা চোখ সরু করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, "ইয়ার হোসেন.....তোমাকে আমি আর তো সহ্য করবোনা! এই খাজ়ানা শুধু আমার, এদিকে নজর দিয়ে খুব ভুল করলে!" হতচকিত ইয়ার হোসেন হাঁ হাঁ করে উঠলো, "এ....এটা তুমি কি করছো ব্র্যন্ডন? আ..আমরা দিনের পুরোনো বন্ধু!" ব্র্যান্ডন মুচকি হেসে রিভলবারটা চেপে ধরলো ইয়ার হুসেনের কপালে, ইয়ার হোসেন হাত দুটো জড়ো করে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো, "আ..আমায় তুমি ছে..ছেড়ে দাও ব্র্যান্ড..ন্! আমার খাজানা চাইনা!!" ব্র্যান্ডন ফিসফিস করে বললো, "বিদায় বন্ধু" তারপরেই টিপে দিলো ট্রিগার, একটা ফাঁকা আওয়াজ; পরক্ষণেই বারুদের গন্ধ আর মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো ইয়ার হোসেনের রক্তাক্ত শরীর। নীল ঘটনার আকস্মিকতায় ক্ষণিক বিমূঢ় হয়ে পড়লো, কিন্তু পরক্ষণেই স্প্রিং এর মতো লাফিয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লো ব্র্যান্ডনের পাহাড়ের মতো শরীরটার ওপর, ব্র্যান্ডনের হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেলো রিভলবারটা ; নীলের বজ্রমুষ্টির আঘাত ক্ষিপ্র চিতাবাঘের মতো আঘাত করলো ওর চোয়ালে! ʼকোঁকʼ শব্দ করে মাটিতে কাটা কলাগাছের মতো খসে পড়লো ব্র্যান্ডন, নীল ওকে ওঠার সুযোগ না দিয়েই ন্যানো টেকনোলজির গ্লাভস থেকে ৩০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ ছুঁড়ে দিলো ওর ওপর ; থরথর করে কেঁপে উঠলো ব্র্যান্ডনের বিরাট  শরীরটা। পরক্ষণেই একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার শুরু হলো, জাহাজটা হঠাৎ সজোড়ে দুলতে শুরু করলো, ঢেউয়ের গর্জন বেড়ে উঠলো খুব বেশি; এক্ষুণি বুঝি ডুবে যাবে এই ঈউনিকর্ণ! নীল বুঝতে পারছিলো আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবেনা, কিন্তু ব্র্যান্ডনকে একা ফেলে চলে যাবে ও? ব্র্যান্ডন শত্রু হতে পারে, কাসা জলদস্যু হতে পারে, কিন্তু মানুষ তো! নীল নিজের মন স্থির করে ফেললো, ও ঠান্ডা গলায় বললো, "ব্র্যান্ডন, চলো। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকলে আমরা দুজনেই মারা পড়বো!" ব্র্যান্ডন প্রাণপণে চেষ্টা করছিলো সিন্দুকগুলো খোলার, হাতের লম্বাটে ছুরি দিয়ে মোচড় দিচ্ছিলো ক্রমাগত ; নীলের কথা যেন শুনতেই পেলোনা ও। নীল উত্তেজিত স্বরে বললো, "ব্র্যান্ডন, দেরী কোরোনা! বেশি দেরী হলে দুʼজনের কেউ বাঁচবোনা।" ব্র্যান্ডন সহসা ঝকঝকে ছুরিটা নীলের দিকে তুলে পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলো, "ওইইই! খবর্দ্দার! তুই এক-পা ও এগোবিনা আমার খাজ়ানার দিকে.....আমার খাজ়ানা ছেড়ে আমি একʼপা ও নড়বোনা! নিপাত যা!" কথাটা শেষ করেই নীলকে ওর বলিষ্ঠ হাতে এক ধাক্কা দিলো ব্র্যান্ডন, নীল ছিটকে গিয়ে পড়লো মেঝেতে। অন্ধ রাগে নীলের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো, কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে ব্র্যান্ডনকে আক্রমণ করার আগেই আরেকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো; একটা মৃদু খট্ খট্ শব্দ হঠাৎ শুরু হলো কেবিনের ওপরে। নীল ধীরে ধীরে ওপরে চেয়ে যা দেখলো তাতে ভয়ে আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো; কেবিনের ওপরের কাঠের দরজা নিজে থেকেই ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এক অদৃশ্য অপার্থিব শক্তি খেলা করছে গোটা জাহাজে। ব্র্যান্ডন ওদিকে পাগলের মতো হামাগুড়ি দিচ্ছিলো সিন্দুকগুলোর চারপাশে; নীল বেশ বুঝতে পারলো ব্র্যান্ডনকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে এবার ও নিজেও মরবে। একমিনিট ভেবে মন প্রস্ত্তত করে নিলো নীল, পরক্ষণে স্প্রিং এর মতো লাফ দিয়ে কাঠের সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠে এলো ও; ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে কাঠের দরজাটা। একটা বদ্ধ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে ভেতরে, তার সাথে সমুদ্রের ধাক্কায় জাহাজের দুলুনি; মাথাটা হঠাৎ টলে গেলো নীলের। কোনো ভাবে সিঁড়ির পাশের দড়ির হাতল ধরে সামলে নিলো ও; কিন্তু এবার কি হবে? কেবিনের ভেতরের বাতাস ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে; অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। ব্র্যান্ডন ততক্ষণে একটা সিন্দুকের ডালা খুলে ফেলেছে, তার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে পর্টুগীজ প্রাচীন আমলের স্বর্ণমুদ্রা; ব্র্যান্ডন এক ঝটকায় যেন পাগল হয়ে গেলো। ঝাঁপিয়ে পড়লো স্বর্ণমুদ্রার সিন্দুকের ওপরে, দুʼহাতে মোহর নিয়ে পাগলের মতো ছড়াতে লাগলো চারপাশে। ঘোলাটে চোখ, জান্তব স্বরে চিৎকার করছিলো, "শাহেনশা....! আমি শাহেনশা!! এই.....এই সব মোহর আমার; আ-মা-র!" নীল বুঝতে পারছিলোনা ওর এখন কি করা উচিত; দম বন্ধ হয়ে আসছে এই বাতাসহীন কেবিনে। তবে কিছু একটা করতেই হবে, নইলে আর বেশিক্ষণ বাঁচা যাবেনা এখানে! ঠিক তক্ষুণি একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেলো চোখের পলকে; মেঝের এককোণায় পড়ে ছিলো একটা মরচে ধরা প্রাচিনকালের তলোয়ার। হঠাৎ নীল সচমকে দেখলো শূন্যে ভেসে উঠেছে তরোয়ালটা, ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ব্র্যান্ডনের দিকে। কি ঘটতে পারে এরপর, সেটা বুঝতে পেরেই একটা চাপা আর্তনাদ বেড়িয়ে এলো ওর মুখ থেকে! আর....পেছন থেকে গিয়ে ব্র্যান্ডনের পিঠে আঘাত করলো অস্ত্রটা, একটা ভোঁতা শব্দ; এঁফোড় ওঁফোড় হয়ে গেল ব্র্যান্ডনের শরীরটা! শুধু ʼওঁকʼ করে একটা ছোটো আর্তনাদ বেড়িয়ে এলো ওর মুখ থেকে ; সিন্দুকের ওপর লুটিয়ে পড়লো ব্র্যান্ডনের শরীরটা, রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ে লাল হয়ে গেলো স্বর্ণমুদ্রা গুলো। নীল আর একমুহূর্তও দেরী না করে বিদ্যুৎগতিতে বন্ধ দরজাটার কাছে এগিয়ে গেলো; এখন একটাই অস্ত্র সম্বল--ন্যানো টেক-গ্লাভস। নীল দুʼহাতের কবজির বটন প্রেস করলো; দুই তর্জনি থেকে শাঁ করে বেড়িয়ে এলো ঝকঝকে তীক্ষ্ম নখের মতো মেটাল ক্নাঈফ। সমস্ত শক্তি দিয়ে কাঠের দরজায় আঘাত করলো ও; একবার, দুʼবার, তিনবার। হয়েছে! চরচর করে পুরনো আমলের ভিজে কাঠ কেটে আসছে, নীলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠলো! পেছনে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত, যে মৃত্যুদূত অজ্ঞাত! নীল জিবনের তারণায় সমস্ত শক্তি দিয়ে চর্ চর্ শব্দে গোল করে কেটে ফেললো কাঠের দরজার মাঝখানে অনেকটা জায়গা। দমবন্ধ করে ওপরে মাথা তুললো নীল; সমুদ্রের আঁশটে নোনা গন্ধ নাকে এলো, কানে এলো ঝড়ের ঝাপটা আর সমুদ্রের দাঁতাল শুয়োরের মতো গর্জন! বুক ভরে দম নিলো নীল; তারপর ধীরে ধীরে উঠে এলো ভাঙাচোরা ডেকে। মৃত্যুকে কি সত্যিই ফাঁকি দেওয়া যাবে? সামনে উত্তাল সমুদ্র মৃত্যুর ফাঁদের মতো বেছানো, পেছনে অজ্ঞাত এক মৃত্যুদূত! কিন্তু নীল বরাবরই বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে যে কোনো বিপদে; যে জন্য অনঙ্গদেব বলেন ওর নার্ভ বোধহয় স্টিলের তৈরি। এই মহাসমুদ্রে হাঙর কুমীরের পেটে যেমন প্রাণ যেতে পারে, তেমনই কোনো দিশা মিলতেও পারে কোথাও; কিন্তু এই অভিশপ্ত ঈউনিকর্ণে জিবনের সে আশাটুকুও নেই। সুতরাং উত্তাল সমুদ্র্রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো নীল; আর সঙ্গে সঙ্গেই বড় বড় দুʼতিনটে ঢেউয়ের ধাক্কায় ছিটকে অনেকটা দুরে চলে এলো ও। নীল প্রবল জলোচ্ছাসে হাঁফিয়ে উঠছিলো, মাথাটা একেকবার ওপরে তুলে বড় করে দম নিয়ে নিচ্ছিলো ও; কিন্তু এভাবে কতক্ষণ? শরীর ভারী হয়ে আসছে, দমও ফুরিয়ে আসছে; বুকটা বুঝি ফেটে যাবে এবার! তবুও একটা সান্ত্বনাই বোধহয় ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো এখনো; ঈউনিকর্ণ রহস্য আংশিক হলেও ভেদ হয়েছে, ঈউনিকর্ণের সঠিক অবস্থান জানা গেছে। যদি বাস্তবে কোনোভাবে ফিরে যাওয়া যায়; তাহলে সমস্ত জাহাজ ও নাবিকদের ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করে দেওয়া যাবে, কিন্তু সত্যিই কী ফিরতে পারবে নীল? সাঁতার কাটার সমস্ত শক্তিও এবার হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, ভারী হয়ে আসছে শরীর। সব দমও ফুরিয়ে গেছে, ওর অবসন্ন ক্লান্ত দেহটা ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিলো সমুদ্রে; হঠাৎ--একটা জিনিষ দেখে চমকে উঠলো নীল! সামনে....বিশ-বাইশ হাত দুরে বালির চর দেখা যাচ্ছেনা? পূব আকাশের প্রথম ভোরের অল্প আলোয় মাত্র কুড়ি হাতের মধ্যে ওই তো কিনারা; ছোট ছোট পাহাড় ঘেরা অস্পষ্ট একটা দ্বীপ। একটা পাগল করা আনন্দ একনিমেষে জাপটে ধরলো ওকে, সমস্ত শক্তি যেন মুহূর্তে ফিরে এলো শরীরে। মাথাটা ওপরে তুলে একবুক দম নিয়ে সাঁতরাতে শুরু করলো নীল; সমুদ্র এখন অনেকটা শান্ত, আকাশেও মেঘ নেই বললেই চলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরটা এসে পড়লো চরায়; ভিজে বালির ওপর। নীল উঠে দাঁড়ালো ধীরে ধীরে,প্রথম ভোরের সুর্যের লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ছে দ্বীপের চারপাশে; এই দ্বীপের গাছপালা সবই ওর অচেনা, আমাদের চারপাশের সাথে কোনো মিল নেই। লাল সবুজ বেশ বড়মাপের পাতা গাছে গাছে, মোটা মোটা গাছের গা এবড়ো খেবড়ো, রুক্ষ। কোনো কোনো গাছের আবার শরীর কাঁটা কাঁটা, লালচে টিলা দ্বীপের চারপাশে ঘিরে আছে। অদ্ভুত কোমল, শান্ত লাগছে চারপাশ; পুর্ব আকাশে যেন সহস্র মণি মাণিক্যের মেলা, ঈশ্বরের এই অপার সৌন্দর্যের চেয়েও বড় কোনো সম্পদ কি আছে এই নশ্বর পৃথিবীতে? এতো সুন্দর পৃথিবীতেও মানুষ তুচ্ছ ধনরত্নের জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে! নীল টলতে টলতে এসে ভিজে নরম বালির ওপর বসে পড়লো, খুব ক্লান্ত লাগছে ওর, এখন একটা সলিড ঘুম প্রয়োজন। বালির ওপর বসে ধীরে ধীরে ঘুমের আঠা লেগে যাচ্ছিলো দুʼচোখে; হঠাৎ একটা বিকট শব্দে সচমকে উঠে দাঁড়াল নীল! শব্দটা যেন সারা দ্বীপে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো,বাঘের মুখে মরণ যন্ত্রণায় গোরুর আর্তনাদের মতো রক্তজল করা সেই গর্জন! পৃথিবীর কোনো প্রাণী কি পারে এমন গর্জন করতে? নীল বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে এসে তাকালো ওপর দিকে, সেখানে তখন একটা ছোটোখাটো আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে; পাখির দল ডানা ঝটপটিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের মাথায়! নীল ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়লো ক্ষণিকের জন্য; কোন প্রাণী ডেকে উঠল এমন সমস্ত চরাচর কাঁপিয়ে? কি আছে এই দ্বীপের রহস্য??


অলংকরণ- অতনু ভট্টাচার্য 

Wednesday 9 May 2018

মাতৃপূজা


প্রথম দৃশ্য
(জেলখানার মধ্যে বিপ্লবী বিজয়ের ওপরে অকথ্য অত্যাচার করছেন দারোগা বিধুবাবু আর ডগলাস সাহেব।)
ডগলাসঃ- বলো! ঠিক করিয়া বলো কোথায় আছে ওই মুখুন্ডা ডাস? বলো নিগার! নইলে টোমাকে আমি শেষ করিয়া দিবো।
বিজয়ঃ- জানিনা!
ডগলাসঃ-(ধমকে) স্ক্রাউন্ডেল নেটিভ! সত্য করিয়া বলো-কোঠায় মুখুন্ডা? কোঠায়?
বিধুবাবুঃ-ডগলাস স্যার--এই লোকটা সব জানে। আজই সন্ধ্যায় ও-ওই মুকুন্দ দাশের একটা গোপন ডেরা থেকে এই হতভাগাকে পাওয়া গেচে! মুকুন্দ তার দলবল নিয়ে আগেই পালিয়েচে। তবে--তার ওই হারমোনিয়াম খানা আমরা উদ্ধার করেচি!
ডগলাসঃ-(হিংস্র হেসে)ওওহো! তবে তো এই নিগারকে ছাড়া চলিবেনা। (বিজয়ের কলার চেপে ধরে)হে-হেই! টেল! টেল মি কোঠায় পলাইয়াছে মুখুন্ডা ডাস। (চিৎকার করে) আই ওয়ন্ট ইওর রাইট কনভেঈন্স!
বিজয়ঃ- (হুঙ্কার)বলবোনা! আর একবার যদি নিগার বলো সায়েব....জিব টেনে ছিঁড়ে নেবো তোমার।
(সাহেব মাটিতে হাত বেঁধে পড়ে থাকা বিজয়কে লাথি মারেন)
বিজয়ঃ- (আর্তনাদ)আঃ! আঃ!
ডগলাসঃ- স্ক্রাউন্ডেল নিগার।
বিধুবাবুঃ- বল; বলে দে হতভাগা! কেন ওই হতভাগা খুনে ডাকাতটার জন্য মার খাবি?
বিজয়ঃ- খবর্দ্দার! খবর্দ্দার সাহেব! ও কতা মুখে আনবেনা। মুকুন্দদা খুনী? ডাকাত?
বিধুবাবুঃ- বটেই তো! তিনজন কনস্টেবলকে গুলি করে মেরেচে সে। গান বেঁধে কাঁচা বয়সের ছেলেদের মাতা খেয়েচে! তাদের  দিয়ে একটার পর একটা ডাকাতি করিয়ে চলেচে।
ডগলাসঃ- টুমি যদি না বলো- টুমাকে আমি এমন পানিশমেন্ট দিবো টুমি কল্পনাও করিতে পারিবেনা!
বিজয়ঃ- কি করবে তুমি লালমুখো শয়তান? (ক্রর হেসে) পারবেনা! কিছুতেই পারবেনা আমার মুখ থেকে বের করতে।
ডগলাসঃ- (বিধুবাবুর দিকে চেয়ে)ভটচায্যি, আই ওয়্ন্ট আ নেটিভ ফ্ল্যাগ.....নাঔ! যাও, নিয়া আইসো।
বিধুবাবুঃ- আচ্ছা স্যার!
(বিধুবাবু একখানি ভারতের পতাকা নিয়ে এলেন)
ডগলাসঃ-(বিজয়ের ঘাড় চেপে ধরে দাঁত খিঁচিয়ে) হেঈ নিগার! থ্রোউ স্পিটল ইন দিজ় ফ্ল্যাগ। থ্রো...থ্রোউ নাঔ!
বিধুবাবুঃ- (ক্রর হেসে ভ্রু নাচিয়ে) সায়েব তোকে ওই পতাকার ওপর থুতু ফেলতে বলচে; ফেল হতভাগা! ফেল!!
বিজয়ঃ- (চোখ বড় বড় করে) আমায় তুই মেরে ফেল লালমুখো কুকুর! মেরে ফেল! তবু একাজ আমি করবোনা!(চিৎকার করে) মরে গেলেও না!!
ডগলাসঃ-(লাথি মেরে) আই স্যয় থ্রো স্পিটল---থ্রো!
বিজয়ঃ- (যন্ত্রণাকাতর মুখে) বন্দে......মাতরম!!(ডগলাস পুনর্বার লাথি মারে)বন্দে.......মাতরম!!
ডগলাসঃ- বল তাহলে....বল!
বিজয়ঃ- বললাম তো....বলবোনা!
ডগলাসঃ-(কোমর থেকে রিভলবার বের করে)তো মৃত্যুর জন্য প্রস্ত্তত হও।
বিজয়ঃ- (সচিৎকারে) বন্দে........মাত....রম্!
(ডগলাস পকেট থেকে রিভলবার বের করে বিজয়ের কপালে ফায়ার করে)
বিপ্লবীঃ- (মৃত্যুযন্ত্রণায়) আ-আ-আ-আ-ব-ন্দে-মা-ত-র-ম!!
          (পর্দা নেমে যায়, প্রস্থান)

দ্বিতীয় দৃশ্য
    (আবহ সংগীতের সাথে স্টেজে ধীরে ধীরে আলো জ্বলে উঠবে, দেখা যাবে চারণকবি গান গাইছেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে, দুʼপাশে চারজন বিপ্লবী)
মুকুন্দঃ-(গান) বন্দেমাতরম!
         বন্দেমাতরম! বন্দেমাতরম!
        বন্দেমাতরম বলে নাচো রে সকলে
       কৃপাণ খুইয়া হাতে দেখুক বিদেশী
       হাসুক অট্টহাসি কাঁপুক মেদিনী
        ভিম পদাঘাতে বন্দেমাতরম!
      বাজাও দামামা ধরো ধামসা ঢোল
       শঙ্খ কলতান; জয়ডঙ্কা খোল!
       নাচুক ধমনী শুনিয়া সে বোল
      হোক নুতন খেলা শুরু এ ভারতে!
       বন্দেমাতরম বন্দেমাতরম
             বন্দেমাতরম!!
    এখনো কি তোদের আছে ঘুমঘোর?
    গেছে কূলমান মোছো আঁখি লোʼর;
     হও আগুয়ান ভয় কিরে তোর?
   বিজয় পতাকা তুলে নিয়ে হাতে---
              বন্দেমাতরম্!!
(হঠাৎ গান থামিয়ে দেবে, একজন বিপ্লবীর প্রবেশ)
বিপ্লবীঃ- মুকুন্দদা! পা....পালাও!! গোরা পুলিশরা এ....এদিকেই ছুটে আসছে!
মুকুন্দঃ-কি....ক্কি বললে অশোক? পুলিশ?
অশোকঃ- হ্যাঁ...হ্হ্যা মুকুন্দদা! একজন গোরা পুলিশ আর...আরেকজন দিশি দারোগা!
মুকুন্দঃ-(গায়ের আলোয়ান ভালো করে জড়িয়ে)শো..শ্শোনো; অশোক! তরুণ, সুখেন। তো...তোমরা আমাদের গোপন ডেরায় পালিয়ে যাও!! আমি চললাম! আমাকে ওরা কোনোভাবেই ধরতে পারবেনা।(মাথা থেকে আলোয়ান দিয়ে দ্রুত প্রস্থান)
     (বিধুবাবু আর ডগলাসের প্রবেশ)
ডগলাসঃ- (রিভলবার উঁচিয়ে) হেই! ডোন্ট মুভ! ডোন্ট মুভ এনিবডি!
বিধুবাবুঃ- এবার? সব ব্যাটাকে গারদে পুরবো! ব্যাটাচ্ছেলেরা এখেনে লুকিয়ে ছিলো?
      (সবাই হাত তোলে ওপর দিকে)
ডগলাসঃ-(বিধুবাবুর উদ্দেশ্যে)বাট ভটচায্যি; হু ইজ মুখুন্ডা?
বিধুবাবুঃ-(চোখ গোলগোল করে) তাইতো! মুকুন্দ দাশ তো এখানে নেই! কিন্তু.....ছিলো স্যার! তার প্রমাণ ও...ওই হারমোনিয়াম। পালিয়েচে স্যার; আবার পালিয়েচে!
ডগলাসঃ- হোয়াট? ভটচায্যি....আমি ইহাদের দেখিতেছি, টুমি দেখো কোথায় মুখুন্ডা! যাও..কাম অন....গোওওও! আমরা একটু আগেও শুনেছি সে গান গাহিটেছিলো...এর মধ্যে কোঠায় পালাইবে?
           (বিধুবাবুর দ্রুত প্রস্থান)
ডগলাসঃ- আই উইল এরেস্ট অল অফ ঈউ! চলো--চলো আমার সহিত! কোনো চালাকির চেস্টাও করিবেনা। তাহা হইলে আমি ফায়ার করিটে বাধ্য হইবো! চলো! গোওওও!!
বিপ্লবীরাঃ-(একত্রে) বন্দে....মাতরম্!
                   (প্রস্থান)

তৃতীয় দৃশ্য
  (মুকুন্দ দাশ পালাচ্ছিলেন, সহসা বিধুবাবুর প্রবেশ)
বিধুবাবুঃ- দাঁড়াও মুকুন্দ!! দাঁড়াও!(রিভলবার উঁচিয়ে)
মুকুন্দঃ- (পিছনে চেয়ে থমকে যায়)এ...একি? পুলিশ!!
বিধুবাবুঃ-(অট্টহাস্য)হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! কি ভেবেছিলে মুকুন্দ দাশ? গোরা পুলিশরা এতোই বোকা? তুমি দিনের পর দিন.....পার্বত্য মূষিকের মতো পালিয়ে বেড়াবে, আর আমরা? আমরা অরণ্যে রোদন করে বেড়াবো? হাঃ হাঃ হাঃ! এবার কি করবে তুমি?
মুকুন্দঃ-(ঘুরে দাঁড়িয়ে)মুর্খ তুমি দারোগা সাহেব! মহা মুর্খ!! বাঙালি হয়ে, বাংলা মায়ের সন্তান হয়ে লালমুখো সাহেবদের গোলামি করছো...শুধু দুটো পয়সার জন্য? ছিঃ! ছিঃ! ধিক্ তোমাকে দারোগা সাহেব-ধিক্।
বিধুবাবুঃ- (ক্রর হেসে)ওভাবে তো আমাকে ভোলানো যাবেনা মুকুন্দ দাশ। পালাবে ভেবেচো আবার? উঁহু! ওটি হচ্চেনা; আমি..এই বিধুভুষণ ভটচায্যি থাকতে ওটি আর হচ্চেনা।
মুকুন্দঃ-(ওপরে দুʼহাত তুলে)ধরো, ধরো আমাকে; ধরো। তোমাদের মতো নীচ; সাহেবদের পা চাটা কুকুরদের এই মুকুন্দ দাশ ঘৃণা করে, দারোগা সাহেব! যারা--দুটো পয়সার জন্য ঐ নীচ লালমুখো শয়তানদের পা চাটে; আমি তাদের ঘৃণা করি, ছিঃ! (মুকুন্দ থুথু ছেটায় মাটিতে)
বিধুবাবুঃ-(অন্ধরাগে)মু-কু-ন্দ-দা-শ!
(মুকুন্দ লাফিয়ে উঠে বিধুবাবুর হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নেয়)
বিধুবাবুঃ- আঁ আঁ আঁ(আর্তনাদ)!
মুকুন্দঃ-(রিভলবার উঁচিয়ে)হাঃ হাঃ হাঃ। অত সহজে কি মুকুন্দ দাশকে ধরা যায় দারোগা সাহেব? বন্দুক হাতে থাকলেই ক্ষমতার বড়াই তোমাদের, আর নিরস্ত্র হলেই সব ক্ষমতা--লোপাট? কই? করো দেখি আমাকে গ্রেপ্তার, করো!!
বিধুবাবুঃ-(হাতজোড় করে ভীতকন্ঠে) মুকুন্দ...মুকুন্দ! ছেড়ে দাও আমাকে! দয়া করো আমাকে; মেরোনা বাবা! আমি চাকুরি করি মাত্র। ছেড়ে দাও বাবা! আমায় তুমি ছেড়ে দাও!!
মুকুন্দঃ-অত সহজে? তোরা আমাদের দেশের মানুষগুলোর ওপর কুকুরের মতো অত্যাচার করিস! বন্দুকের সামনে আমাদের দেশের অসহায় মানুষগুলো যখন হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চায়.....তখন? তখন তোরা তাদের শেষ করে দিস নির্দয় ভাবে। না--তোকে আমি ছাড়বোনা! দেশের মানুষ হয়ে যারা দেশের মানুষের সর্বনাশ করে....তাদের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবি।
বিধুবাবুঃ-(সবেগে মাথা নেড়ে) না ন্না না!!
(সহসা আবহে বুটের শব্দ)
মুকুন্দঃ-ও...ওই বোধহয় গোরা পুলিশরা এসে গেলো আর তো থাকা চলেনা! মৃত্যুর জন্য প্রস্তত হও দারোগা সাহেব, মৃত্যুর জন্য প্রস্তত হও।
(গুলির শব্দ, বিধুবাবু আর্তনাদ করে বুক চেপে পড়ে গেলেন, মুকুন্দের সবেগে প্রস্থান। তৎক্ষণাৎ ডগলাসের প্রবেশ।)
ডগলাসঃ- এ...একি? ভটচায্যি!!!
বিধুবাবুঃ-(গোঙাতে গোঙাতে) স্যা...স্স্যার! মু..ম্মকুন্দদ্দ.....!(মাথাটা ঢলে পড়লো)
ডগলাসঃ-নোওওওও!!(চিৎকার করে)মুখুন্ডা ডাস!! আই উইল এরেস্ট ঈউ এনি....কউস্ট!!
                    (প্রস্থান)

চতুর্থ দৃশ্য
     (সাবেকি আমলের ঘর; চেয়ার, টেবিল, খাতা, দোয়াত, কলম, আর কেদারায় বসে লেখায় নিমগ্ন রবীন্দ্রনাথ।)
রবীন্দ্রনাথঃ- (লিখতে লিখতে ফিসফিস করে)
               তখন রাত্রি আঁধার হলো
                   সাঙ্গ হলো কাজ
                দুʼএকজনে বলেছিল
               আসবেনা কেউ আজ।
             মোদের গ্রামের দুয়ার যত
              রুদ্ধ হলো রাতের মত,
             আর সকলে বলেছিলো
              আসবে মহারাজ!
(কলম থেমে যাবে, অন্যদিকে চেয়ে স্মিত হেসে অস্ফুট স্বরে)
            আমরা হেসে বলেছিলেম
             আসবেনা কেউ আজ।
         (চাকর বনমালির প্রবেশ)
বনমালিঃ-আসবো বাবামশাই?
রবীন্দ্রনাথঃ-(বিভোরতা কেটে চমকে)কে?ও,তুমি?এসো, এসো। কিছু বলবে বুঝি?
বনমালিঃ-আজ্ঞে বাবামশাই, এক কাবলেওয়ালা এসচেন দ্যাকা করতে!
রবীন্দ্রনাথঃ-কি? কাবুলিওয়ালা? বাবাঃ! তা সে কি চায়?
বনমালিঃ-আজ্ঞে...আপনার সাথে দ্যাকা করতে চায়!
রবীন্দ্রনাথঃ-আমার সাথে? কাবুলিওয়ালা? নাঃ!তাহলে তো দেখা করতেই হয়। কিন্তু....আমি তো এখন লেখা ছেড়ে উঠতে পারিনে, ব্যস্ত আছি। তাকে তুমি এখানে নিয়ে এসো।
বনমালিঃ-আজ্ঞে বাবামশাই।
           (বনমালির প্রস্থান)
রবীন্দ্রনাথঃ-(কলম কলমদানীতে রেখে)ব্যাপার কি? হঠাৎ আমার কাছে কাবুলিওয়ালা কেন? নাঃ! ভাবিয়ে তুললে দেখচি।
          (কাবুলিওয়ালার প্রবেশ)
কাবুলিঃ-আরে; নমস্তে নমস্তে বাবুসাব, নমস্তে।
রবীন্দ্রনাথঃ-(উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে)নমস্কার। কিন্তু....আপনাকে তো ঠিক চিনলুম না!
কাবুলিঃ-হা খুদা! আপনি হামাকে কেনো চিনবেন? লেকেন, হামি আপনাকে জ়রুর চিনি; হাঁ!
রবীন্দ্রনাথঃ- আমাকে আপনি চেনেন? কিন্তু....কিভাবে?
কাবুলিঃ-কিযে বোলেন বাবুসাব! সারা দেশ যার বন্দনা কোরে, সেই বিশ্ববরেণ্য স্বনামধন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কে না চেনে?
রবীন্দ্রনাথঃ-হ্যাঁ, তা না হয় বুঝলুম। কিন্তু আপনার পরিচয় তো পেলুম না।
কাবুলিঃ-হামি কাবলেওয়ালা আছি বটে--হাঁ! কাবলেওয়ালা আছি।
রবীন্দ্রনাথঃ-হ্যাঁ(হেসে), সেতো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু এই ছদ্মবেশের আড়ালে কোন বাঙালি শ্রীমান রয়েচেন; সেটা মহানুভব বলবেন কি?
কাবুলিঃ-(সচমকে)কি?(অল্প হেসে শুদ্ধ বাংলায়)ভাগ্যিস; ভাগ্যিস আপনি কবি। পুলিশের টিকটিকি হলে তো এতক্ষণে.....!
(রবীন্দ্রনাথ অবাক, কাবুলিওয়ালা দাড়ি খুলতেই দেখা যায় মুকুন্দ দাশ)
রবীন্দ্রনাথঃ-(উচ্ছসিত স্বরে)কি আশ্চর্য!! এ যে মুকুন্দ! কিন্তু...তুমি এ-এই ভাবে?
মুকুন্দঃ-আপনি তো জানেন রবীবাবু, আমার বর্তমান অবস্থা....!
রবীন্দ্রনাথঃ-হ্যাঁ, আমি শুনিচি বটে। ইংরাজ পুলিশ তোমাকে পাগলের মতো খুঁজছে।
মুকুন্দঃ-(হেসে)যাক সে কথা---আপনি বলুন তো; আপনি কি করে বুঝলেন যে আমি কাবুলিওয়ালা নই? আমার তো মনে হয়না.....আমার ছদ্মবেশে কোনো ত্রুটি ছিলো।
রবীন্দ্রনাথঃ-(হাসতে হাসতে)না না! ছদ্মবেশ তোমার সঠিকই ছিলো; কিন্তু ত্রুটি ছিলো হচ্চে গিয়ে....ভাষায়।
মুকুন্দঃ-ভাষায়?
রবীন্দ্রনাথঃ-হ্যাঁ, ভাষায়। (হেসে) তুমি ঐ যে বাক্যগুলি বলছিলে, কি যেন বাক্যগুলি? ঐ যে ʼবন্দনাʼ, ʼবিশ্ববরেণ্যʼ, ʼস্বনামধন্যʼ এইসব। এইসব বাক্য কোনো কাবুলের হিং সুরমা বিক্রেতার জানার কতা কি? না না! মুকুন্দ, না! তুমি ওই কাবুলেদের হিন্দি ভাষাটি এখনো রপ্ত করতে পারোনি।
(মুকুন্দ মুক্ত কন্ঠে হেসে ওঠেন "হাহা" করে)
রবীন্দ্রনাথঃ- তা বোসো তুমি, দাঁড়িয়ে কেন? বোসো।
(মুকুন্দ কেদারায় বসেন, রবীন্দ্রনাথও।)
মুকুন্দঃ-রবীবাবু, অনেক খবরই আপনার বিষয়ে আমার কর্ণগোচরে এসেছে। ইতিমধ্যেই আপনি ইংরাজদের কাছে ʼনাঈটহুডʼ উপাধী পেয়েচেন নাকি?
রবীন্দ্রনাথঃ-(মাথা নত করে) ওকথা বলে আমাকে লজ্জা দিওনা মুকুন্দ! ওই উপাধী গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে, না পারি গিলতে, না পারি উগরোতে। এই অসহ্য ভার বয়ে বেড়াতেও পারিনে, আবার এতো আর বস্ত্ত নয়, যে ছুঁড়ে ফেলে দেবো। এ বড় লজ্জার উপাধী মুকুন্দ, বড় লজ্জার উপাধী!
মুকুন্দঃ-না না! সেকি কতা? এতো আপনার প্রাপ্য ছিলো; আপনি যে বিশ্বকবি(বিনয়ী হেসে)।
রবীন্দ্রনাথঃ- মুকুন্দ, তুমি আমার চেয়ে অনেক মহৎ কাজ করেচো। তোমার রচিত নাটকগুলি যেখানে যেখানে অনুষ্ঠিত হয়েচে, সেই স্থানের ইংরাজ পুলিশরাই বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছে! স্বয়ং শ্রীমৎ অশ্বিনী দত্তের সান্নিধ্যধন্য তুমি, আর কি বলবো?
মুকুন্দঃ-(হাত কচলে) না না রবীবাবু; এসব নিতান্তই সামান্য ব্যাপার। আপনি মহৎ মানুষ বলেই এতটা বিনয়ী হতে পারছেন!
রবীন্দ্রনাথঃ-না মুকুন্দ; না! সামান্য নয়। আমাদের যুবশক্তিকে প্রেরণা জোগায় তোমার ওই গান; আমার তো ভয় হয়, তোমার ওই ʼমাতৃপুজাʼ নাটকখানি কোনদিন না সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
মুকুন্দঃ-তাই যদি হয় রবীবাবু, আমি সেদিনই আরেকটি স্বদেশী নাট্য রচনা করে ব্রিটিশের সামনে মেলে ধরবো।
রবীন্দ্রনাথঃ- (মুকুন্দের পিঠে হাত রেখে)এ...এই জন্যই; এইজন্যই তোমার এই নির্ভীকতা বড় প্রিয় আমার। যাক সে কথা; বলো, তুমি বলো--হঠাৎ এভাবে আমার কাছে?
মুকুন্দঃ-একটি প্রস্তাব আছে রবীবাবু।
রবীন্দ্রনাথঃ- প্রস্তাব? কি প্রস্তাব?
মুকুন্দঃ- দেখুন--এই মুহুর্তে কলকাতা আমার পক্ষে নিরাপদ নয়। পুলিশের কড়া নিরাপত্তা কম যদি বলি, সে একমাত্র গাঁয়ে গঞ্জে! আর গ্রাম বলতেই মনে পড়লো আপনার আশ্রমের কতা, বীরভুমের কতা। কিন্তু রেলগাড়িতে যাওয়ার পথে যদি রেলপুলিশরা আমাকে চিনে ফেলে? তাই আপনি যদি দয়া করে আপনার মোটরে....!
রবীন্দ্রনাথঃ-(স্মিত হেসে) তা বেশ তো! আমিতো আগামী তিনদিন পরে এমনিতেও বসন্তোৎসবে আমাদের আশ্রমে যাচ্ছি; তুমিও চলো না হয় আমার সাথে।
মুকুন্দঃ- তা--আমি ভাবছিলাম বীরভুমে যখন যাচ্ছি, তখন একবার তারাপীঠ ভৈরব বামদেবকে দর্শন করে এলে....!
রবীন্দ্রনাথঃ- কি বললে মুকুন্দ? বামদেব? মানে...বামাক্ষ্যাপা?
মুকুন্দঃ-হ্যাঁ....আপনি চেনেন তাঁকে? জানেন তাঁর কথা?
রবীন্দ্রনাথঃ-(সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে)হ্যাঁ মুকুন্দ। আমি জানি; আমি অনেক শুনেচি তাঁর কথা!আমার পিতা....প্রথম তাঁরই নির্দেশে শান্তিনিকেতন আশ্রম গড়ে তোলেন। একথা....আমি বহুবার শুনেচি পিতার মুখে!
আর আমাদের আশ্রমের অধ্যক্ষ ভুপেনবাবু; ভুপেন্দ্রনাথ সান্যাল! তিনিও এই বামদেবের একনিষ্ঠ ভক্ত। যদিও.....আমার কখনো তাঁকে স্বচক্ষে দেখা হয়ে ওঠেনি, তবু.....! আমি তোমার সহিত যাবো মুকুন্দ; আমারও বহু দিনের ইচ্ছে তাঁকে একবার দর্শন করার।
মুকুন্দঃ-(উচ্ছস্বিত স্বরে) কি..ক্কি বললেন রবীবাবু? আপনি যাবেন আমার সহিত? যাবেন?
রবীন্দ্রনাথঃ-হ্যাঁ মুকুন্দ, তুমি প্রস্তত হও।(কেদারা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে) আমি কালই বীরভুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে চাই। একদিন সেখানে কাটিয়ে বোলপুরে আমাদের আশ্রমে যাওয়া যাবে!
মুকুন্দঃ-(উঠে দাঁড়িয়ে) বেশ বেশ, ত-তবে তাই হোক। (কপালে হাত ঠেকিয়ে) জয় মা তারা!!

পঞ্চম দৃশ্য
    (কুটিরের দাওয়ায় বসে গান গাইছেন বামদেব)
বামদেবঃ-(গান) আমার চেতনা চৈতন্য করে
                    দে মা চৈতন্যময়ী,
                  তোর ভাব সাগরে ভেসে আমি
                  হবো মা তোর পদাশ্রয়ী!
                 অজ্ঞান মোর সভা থেকে
                তোর ভাবে তুই নে মা ডেকে;
                জ্ঞানচক্ষু মেলে দেখি মা
                 কেমন তুই জ্ঞানদাময়ী।
                 তোর ভাবের খেলা দিয়ে,
                দে মা আমার যা কিছু সব
                অভাব মিটিয়ে!
               কূতুহল মোর এই জীবনে,
              নিয়ে নে মা তোর ও চরণে;
              মহানন্দে যাই চলে মা--
               হয়ে সর্ব ঋপু জয়ী।
      (বামদেবের অনুচর গদাইয়ের প্রবেশ)
গদাইঃ- বাবা!
বামদেবঃ- গদাই? আয় আয়; কি ব্যাপার রে? কি ব্যাপার? কলকেতা থেকে দুটি বাবু এসেচেন বুঝি? কলকেতা থেকে দুটি বাবু এসেচেন?
গদাইঃ-(সচমকে) আ..আপনি জানেন বাবা?
বামদেবঃ-(শিশুর মতো হেসে) জানি বৈকি রে ব্যাটা; জানি বৈকি! এক ব্যাটার নাম--মুকুন্দ দাশ; আরেক ব্যাটা....আরেক ব্যাটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ! আমাদের ওই....দেবেন ঠাকুরের ছেলে।
গদাইঃ-(হেসে) ঠিক ঠিক বাবা!( পেছনে চেয়ে)আসেন--আপনারা আসেন।
          (মুকুন্দ আর রবীন্দ্রের প্রবেশ)
মুকুন্দঃ-(হাত জড়ো করে)নমস্কার বামাঠাকুর!
  (রবীন্দ্রনাথ দুটি হাত বুকের কাছে জড়ো করেন)
বামদেবঃ- আ..আরে এসো এসো বাবারা...এসো! তোমাদের আগমনে আমার এই শ্মশানের আশ্রম আলোয় আলো হয়ে উঠেছে গো; আলোয় আলো হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথঃ-কিন্তু বামদেব; আপনি কি করে জানলেন আমরা আসবো আপনার নিকট?
বামদেবঃ-ওই দ্যাখো; কি করে আবার গো? কি করে আবার? আমার---আমার বড়মা আমার কর্ণকূহরে এসে বললে, "বামা, কলকেতা থেকে দুই মহা ওস্তাদ লোক আসছে রে...মহা ওস্তাদ লোক আসছে!" আমার সামনে...দেশের দুই ভবিষ্যৎ; আমি ধন্য হলাম গো বাবারা....ধন্য হলাম।
মুকুন্দঃ- (বিনয়ী স্বরে)কি-ক্কি যে বলেন বাবা! আমরা এমন কিছুই করিনি।
বামদেবঃ-(গদাইয়ের দিকে চেয়ে) তুই এখনো চুপ করে দাঁড়িয়ে কেন,হ্যাঁ? চুপ করে দাঁড়িয়ে কেন? মুখ্যু কোথাকার--যা, যা! দুটো চাটাই নিয়ে আয়....যা!
রবীন্দ্রনাথঃ-আহা, বামদেব; আপনাকে আমাদের জন্য এতো ব্যস্ত হতে হবেনা।
বামদেবঃ- (হাসতে হাসতে) ব্যস্ত হবোনা কিগো? ব্যস্ত হবোনা কি? আমার একপাশে....চারণকবি; আরেকপাশে বিশ্ববরেণ্য কবি!
         (দুজনেই সলজ্জ হাসেন)
বামদেবঃ- বুঝলে বাবা মুকুন্দ, বুঝলে? এই..তোমাতে আর আমাতে কোনো তফাৎ নাই গো; কোনো তফাৎ নাই! আমরা দুজনেই মাতৃপুজা করি, তুমি করো দেশমাতৃকার পুজা; আর আমি করি....আমার তারা মায়ের পুজা গো---তারা মায়ের পুজা।
রবীন্দ্রনাথঃ-(মৃদু হেসে)মুকুন্দের রচিত গানগুলি যে ইংরাজ সরকারকে বড়ই দুশ্চিন্তায় রেখেছে, সে সংবাদ আপনি জানেন কি?
বামদেবঃ-তাই নাকি গো? তাই নাকি? তা বেশ, তা বেশ বাবা! ওই লালমুখো আপদগুলোকে....বিনা রক্তে বিদেয় করতে পারলে;আমার চেয়ে খুশী আর কেউ হবেনা গো, কেউ হবেনা। (মুকুন্দের দিকে চেয়ে) তা বাবা মুকুন্দ; তুমি তোমার রচিত একখানি গান আমায় শোনাও না বাবা---শোনাও না!
মুকুন্দঃ-আপনি.......শুনবেন বাবা?
বামদেবঃ- হ্যাঁগো---শুনবো বৈকি...শুনবোতো! গাওনা বাবা; গাওনা।
মুকুন্দঃ-(গান)  ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি
                    বঙ্গনারী; কভু হাতে    
                    আর পোড়োনা!
                  জাগো গো ও জননী
                 ও ভগিনী মোহের ঘুমে
                 আর থেকোনা!
                 কাঁচের মায়াতে ভুলে
                 শঙ্খ ফেলে,
                 কলঙ্ক হাতে পোড়োনা!
                তোমরা যে গৃহ লক্ষ্মী
                ধর্ম সাক্ষ্মী জগৎ জুড়ে
                আছে জানা।
      মায়েরা,চটকদার কাঁচের বালা
               পুঁতির মালা তোমাদের
               অঙ্গে শোভেনা!
               নাইবা থাক মনের মত
               স্বর্ণভুষণ; তাতেও যে দুঃখ
               দেখিনা। সিঁথিতে সিঁদুর ধরি
               বঙ্গনারী; জগতে সতী শোভনা!
               বলিতে লজ্জা করে প্রাণ বিদরে,
               কোটি টাকার কম হবেনা।
              পুঁতি কাঁচ ধুতো মোক্তো এই
              বাংলার ন্যায় বিদেশে কেউ
              কেউ জানেনা! ওই শোনো--
              বঙ্গ মাতা শুধান কথা; জাগো
             আমার যত কন্যা---তোরা সব
             করিলে পণ মায়েরি ধন বিদেশে
              উড়ে যাবেনা! আমি যে অভাগিনী
              কাঙালিনী; দুʼবেলা অন্ন জোটেনা।
              কি ছিলেম কি হইলেম,
             কোথা এলেম; মাযে তোরা                           
            ভাবিলিনা।।
বামদেবঃ- (হেসে) বাঃ বাঃ বাঃ! বড় ভালো গান বেঁধেছো গো মুকুন্দ! বড় ভালো গান বেঁধেছো। তোমার এই গান এই দেশের মানুষদের একসূত্রে বেঁধে রাখবে গো; এক সূত্রে বেঁধে রাখবে।
মুকুন্দঃ-(মাথা নিচু করে) বাবা--আপনার শিষ্য তারাক্ষ্যাপাজি কি বিপ্লবী? আসলে....আমি শুনেচি তিনি অনেক বিপ্লবীকে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেন। তাই বলছিলাম......আরকি!
বামদেবঃ-(মুকুন্দর কাঁধে হাত রেখে) এর উত্তর তুমি যথাসময়ে পাবে বাবা; যথা সময়ে পাবে।
রবীন্দ্রনাথঃ- বামদেব---রাত প্রায় ফুরিয়ে এলো; এবার যে আমাদের ফিরতে হয়।
বামদেবঃ- না, বাবা! না! এভাবে তো আমি তোমাদের যেতে দিতে পারিনা।
মুকুন্দঃ-(অবাক হয়ে) কেন...বলুনতো?
বামদেবঃ-(মুকুন্দর পানে চেয়ে) তোমার কাছে.....ফুটুস্কল আছে।
রবীন্দ্রনাথঃ- মানে?
গদাইঃ-বাবা---বন্দুকের কথা বলচেন!
মুকুন্দঃ-(কোমরের কাছ থেকে রিভলবার বের করে) এইটির কথা বলচেন বাবা?
বামদেবঃ- হ্যাঁ বাবা; এইটি তুমি আমার আশ্রমের দক্ষিণে জীবিত কুন্ডে বিসর্জন দাও।
মুকুন্দঃ-কি-ক্কি??? এ আপনি কি বলছেন বাবা? আপনি বুঝতে পারছেননা; এ আমার কত প্রয়োজনীয় জিনিষ!
বামদেবঃ- জানি বাবা! আমি জানি! কিন্তু.....তোমার ওই কলমই তোমার অস্ত্র। এই-এই বন্দুকের.....বন্দুকের তোমার কোনো প্রয়োজন নেই।
মুকুন্দঃ-কিন্তু.....বাবা! এ আমি ত্যাগ করতে পারবোনা।
বামদেবঃ- (ক্রদ্ধ) কি? আমার আদেশ অমান্য করছিস তুই? এতো সাহস তোর? এতো সাহস?যা.... এক্ষুণি ওই ফুটুস্কল জলে ফেলে দে; যা।
মুকুন্দঃ- (অন্যদিকে চেয়ে নিজের মনে) না! কিছু একটা করতেই হবে! এই অস্ত্র আমি ত্যাগ করতে পারবোনা; আবার---ওনার আদেশ অমান্য করাও অসম্ভব।
    (বামদেব পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখেন)
বামদেবঃ- কি?? কি ভাবছো বাবা মুকুন্দ?
মুকুন্দঃ- (সচমকে) কি-ক্কি? না-ন্না! আমি এক্ষুনি যাচ্ছি বাবা।
(মুকুন্দের দ্রুত প্রস্থানোদ্যোগ, পেছন থেকে বামা)
বামদেবঃ- দাঁড়া। (রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে)বাবা, তুমি একটু ওর সাথে যাও বাবা; তুমি একটু ওর সাথে যাও!
রবীন্দ্রনাথঃ- আচ্ছা বামদেব; আমি যাচ্ছি ওঁর সাথে।(হাসেন)
মুকুন্দঃ-(ত্রস্ত স্বরে) সেকি-ক্কি বাবা? উনি আবার কেন কষ্ট করে......!!
বামদেবঃ-(হেসে)ওরে শালা.....! আমি কি বুঝিনে? আমি কি বুঝিনে তোর মন কি বলছে? না না! রবী...তুমি একটু যাও বাবা.....যাও।
রবীন্দ্রনাথঃ-চলো মুকুন্দ,(মুকুন্দ তবু চুপ করে দাঁড়িয়ে, রবীন্দ্রনাথ হেসে কাঁধে হাত রেখে) কি ভাবছো? চলো!
           (মুকুন্দ ও রবীন্দ্রের প্রস্থান)
গদাইঃ- এ আপনি কি করলেন বাবা? একজন বিপ্লবীকে তার বন্দুক ফেলে দিতে বললেন? দেশ থেকে ইংরেজ কি তবে ফুলের মালা দিয়ে তাড়ানো হবে?
বামদেবঃ- গদাই---কখনো কখনো ফুলের মালা যা পারে; একটা বন্দুক তা করতে পারেনা রে...পারেনা।
               (প্রস্থান)

ষষ্ঠ দৃশ্য
    (রবীন্দ্র ও মুকুন্দ জলাশয়ের কাছে এসেছেন)
রবীন্দ্রনাথঃ- বুঝলে মুকুন্দ? মনে হচ্ছে এই জলাশয়টির কথাই বামদেব বলেছেন।
মুকুন্দঃ- আপনি কত সহজে বলে দিলেন, না? আ...আচ্ছা, আপনার মনে হয়না? একজন বিপ্লবীর কাছ থেকে তার অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার অর্থ অন্যায়!!
রবীন্দ্রনাথঃ- (বিরক্ত) ও! তারমানে বামদেব তোমাকে ওটি জলে নিক্ষেপ করতে বলে অন্যায় করেচেন---এটা বলতে চাইছো?
মুকুন্দঃ- (সজোরে মাথা নেড়ে) না না! আমি এটা কখনোই বলিনি রবীবাবু। আসলে--উনি তো সাধক মানুষ; উনি আর কিকরে বুঝবেন এর গুরুত্ব?
রবীন্দ্রনাথঃ- কি আশ্চর্য! তা তুমি ওনাকে বুঝিয়ে বললেনা কেন যে এর গুরুত্ব কি?
মুকুন্দঃ- আমি তো বললাম, উনি তো শুনতেই চাইলেন না!
রবীন্দ্রনাথঃ- মুকুন্দ.....উনি সত্যই একজন মহান মানুষ। ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস নেই; তাই উনি সত্যিই মহাসাধক বলতে পারিনে! তবে....এটাও ঠিক, আমার জিবনে আমি অমন মহান, সরল, সত্যবাদী মানুষ কখনো দেখিনি। অলৌকিক ক্ষমতা কি জিনিষ আমি জানিনা---কিন্তু আমরা ওঁর সম্মুখে আগমনের সাথে সাথেই উনি আমাদের নাম নির্ভূল বলে গেলেন। আর.....কি অদ্ভুত বিশ্বাসে বললেন ওঁর আরাধ্যা তারা দেবীর কথা! এমন মানুষ কোনো অবিচক্ষণতার কাজ করতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস হয়না।
মুকুন্দঃ- আমি জানি। আমি জানি ওঁর আদেশ অমান্য করতে আমি অপারগ! আবার এটিকে হাতছাড়া করতেও পারবোনা। শুনুননা.....রবীবাবু! আপনি যদি আ-আমায় একটু সাহায্য করেন; তাহলে...!
রবীন্দ্রনাথঃ- কি বলতে চাইচো বলোতো?
মুকুন্দঃ- আ-আমরা যদি এটিকে এখানে কোথাও গোপন স্থানে রেখে যাই...ফেরার সময় আবার এখান থেকে....!
রবীন্দ্রনাথঃ- (চশমা ঠিক করতে করতে) মুকুন্দ! আমার মনে হয়;  বামদেব এরকম কিছু সন্দেহ করেই আমাকে তোমার সাথে পাঠিয়েছেন। এখন.....আমি ফিরে গিয়ে ওনাকে এমন অসত্য বাক্য বলতে পারবোনা!
মুকুন্দঃ-কিন্তু....!
রবীন্দ্রনাথঃ-কোনো কিন্তু নয়। (নরম স্বরে) তুমি কেন বুঝচোনা মুকুন্দ? এই একটি জিনিষের জন্য তুমি অমন মহান মানুষের বিশ্বাস ঘাতক হবে?
মুকুন্দঃ- আ-আমি জানি! কিন্তু আপনি জানেন? এই একটি অস্ত্র জোগাতে আমাকে কত কষ্ট করতে হয়েচে!
রবীন্দ্রনাথঃ- জানি! এটি ত্যাগ করতে তোমার আরো কষ্ট হবে। (কাঁধে হাত রেখে) কিন্তু বামদেব যখন বলেছেন; নিশ্চয়ই নিছক শুধু শুধু নয়! মুকুন্দ--তুমি জানো? আমার পিতা শুধুমাত্র ওঁর কথায় আমাদের অতবড় আশ্রম, বিশ্বভারতী গড়ে তুলেছিলেন। এ থেকেও কি তুমি বুঝতে পারচোনা ওঁর আদেশের মুল্য? তাছাড়া, উনি তোমায় কি বললেন শুনলেনা? কলমই তোমার বড় অস্ত্র!
মুকুন্দঃ- (চোখ জ্বলজ্বলে) ঠিক! ঠিক বলেছেন রবীবাবু; এসবতো আমি ভেবে দেখিনি।
রবীন্দ্রনাথঃ- তবে? তুমি ঐ বস্ত্তটি এবার বিদেয় করো।
মুকুন্দঃ- (রিভলবার কপালে ঠেকিয়ে) বন্দে----মাতরম্!
(জলে নিক্ষেপ করার "ঝপাৎ" শব্দ আবহে, মুকুন্দের মাথা নিচু, রবীন্দ্রনাথ কাঁধে হাত রাখেন। প্রস্থান।)

সপ্তম দৃশ্য
(রোদের আলো, দাওয়ায় বামদেব বসে আছেন। গদাইয়ের প্রবেশ।)
গদাইঃ- বাবা- ভোর যে হলো! এখনো যে তেনাদের দেখা নেই।
বামদেবঃ- (হেসে) দাঁড়া দাঁড়া.....! ব্যাটার অত সাধের ফুটুস্কল; ওকি অত সহজে মায়া যায় রে? মায়া যায়? তবে সঙ্গে ঐ রবীন্দ্রনাথ গেচে....এই রক্ষে! নইলে ও ব্যাটা হয়তো...।
        (মুকুন্দ ও রবীন্দ্রের প্রবেশ)
বামদেবঃ- তোমরা এসে গেচো বাবারা? এসে গেচো? (মুকুন্দের দিকে চেয়ে) কি রে ব্যাটা? কিরে? ওই-ওই ফুটুস্কল খানা জীবিতকুন্ডে বিসর্জন করিচিস তো, হ্যাঁ? করিচিস তো?
মুকুন্দঃ- (হেসে)হ্যাঁ বাবা...আপনার কথা মতো আমি ওটি ঘাটের জলে নিক্ষেপ করেছি।
রবীন্দ্রনাথঃ- আর...এ কথা যে সত্য; তার প্রমাণ আমি।
বামদেবঃ- বেশ বেশ বাবা.....বেশ করেচো। তা বাবা! তুমি যে বিশ্ববরেণ্য কবি গো....বিশ্ব বরেণ্য কবি। তোমার রচিত একখানা গান আমাকে শোনাবেনা বাবা? শোনাবেনা?
রবীন্দ্রনাথঃ- (স্মিত হেসে) বামদেব...আপনার মতো মাতৃসাধক; এমন সরল, নিষ্পাপ সত্যবাদী মানুষ---আমি কখনো দেখিনি। (একটুক্ষণ চেয়ে থেকে গান)
       আমার মাথা নত করে দাওহে তোমার
        চরণ ধুলার তলে; সকল অহংকার হে
        আমার ডুবাও চোখের জলে!
        নিজেরে করিতে গৌরবদান;
        নিজেরে কেবলি করি অপমান,
        আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া;
        ঘুরে মরি পলে পলে।
        আমারে না যেন করি প্রচার,
        আমারো আপন কাজে;
        তোমারি ইচ্ছা করো হে পূরণ
         আমারো জীবনমাঝে!
         যাচি হে তোমার চরম শান্তি
         পরাণে তোমার পরম কান্তি;
         আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও
         হৃদয় পদ্মদলে॥
বামদেবঃ-(রবীন্দ্রনাথের কাঁধে হাত রেখে) আহা! আহা! বড় ভালো গান বাবা; বড় ভালো গান। এই গান, এই কবিতা...তোমাকে শত শত বছর বাঁচিয়ে রাখবে। কবিগুরু হবে গো তুমি; কবিগুরু হবে।
রবীন্দ্রনাথঃ-(অবনত মস্তকে) বামদেব; এবার আমরা রওনা দিই? ভোর হয়ে এসেছে। বেশি বিলম্ব হলে বোলপুরে পৌঁছতে বিলম্ব হবে।
বামদেবঃ- হ্যাঁ বাবা; যাও....যাও বাবা। আমার বড়মা তোমাদের মঙ্গল করুন গো...মঙ্গল করুন।
     (মুকুন্দ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে)
বামদেবঃ-থাক বাবা, থাক। (বুকে হাত রেখে)জয় তারা! জয় জয় তারা!
                 (প্রস্থান)

অষ্টম দৃশ্য
   (সূর্য ডোবার আবহ, আবহ সংগীতে বাঁশির সুর, হেঁটে ফিরছেন রবীন্দ্র ও মুকুন্দ।)
মুকুন্দঃ- রবীবাবু, দেখুন দ্বারকা নদীর ওপারে সমস্ত চরাচর রাঙিয়ে সুর্যদেব উদিত হচ্চেন। (পাখির ডাকের আবহ) শুনুন, একটি দুটি পাখির দিনের প্রথম কলকাকলিতে এই প্রভাত মুগ্ধ হয়ে উঠচে। কিন্তু রবীবাবু....আপনাকে এমন বিষণ্ণ লাগছে কেন?
রবীন্দ্রনাথঃ- না না, কিছুনা মুকুন্দ! (ম্লান কন্ঠে)
মুকুন্দঃ- কেন গোপন করছেন রবীবাবু? বলুননা....কেন এমন বিষণ্ণ আপনি?
রবীন্দ্রনাথঃ- মুকুন্দ; তুমি শুনলে? বামদেব তোমাকে কি বললেন? তোমার গান এই দেশের মানুষকে একসূত্রে বেঁধে রাখবে। কিন্তু মুকুন্দ! তুমি যে এই দেশের জন্য এতো ভাবো, নিজের জিবন পণ করে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ো; আমি তো তার একবিন্দুও কিছু করতে পারলুমনা মুকুন্দ। তোমাদের নখের যোগ্যতাও আমি অর্জন করিনি!
মুকুন্দঃ- এ-এ আপনি কি বলছেন রবীবাবু? আমাকে কজন চেনেন? আপনাকে যেখানে সারা পৃথিবী বরণ করে নিয়েছে----সেখানে আমি এক সামান্য চারণকবি মাত্র! আমার জীবন দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত! আমি তো আজ আছি....কাল নেই। আমার মৃত্যুতে দুʼচারজন নিকট মানুষ ছাড়া কেউ আমাকে মনে রাখবেনা; কিন্তু আপনাকে রাখবে!
রবীন্দ্রনাথঃ- (মাথা নেড়ে) না মুকুন্দ; না! তুমি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্থান না পেলেও মানব হৃদয়ে তুমি আরো কয়েক শতাব্দী বেঁচে থাকবে। কিন্তু আমি? আমিতো কিছুই করতে পারিনি এই দেশের জন্য! আমার কলম আমার অস্ত্র নয়; বিলাস আর অর্থের এক লালিত অংশ মাত্র। তোমরা যা করচো---দেশের জন্য তার সিকিভাগও করতে পারিনা আমি! আমার জিবনটা কেটে গেলো কবির বিলাস, ব্যসনে; আভিজাত্যের নীল রক্ত নিয়ে। আমি পারলুমনা মুকুন্দ......কিছুই করতে পারলুমনা এই দেশটার জন্য!
(মুকুন্দ কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে প্রস্থান করবেন; রবীন্দ্রনাথ চোখ থেকে চশমা খুলে আকাশের দিকে তাকাবেন হতাশ ভাবে)
আবহ সঙ্গীতঃ- অনেক তোমার খেয়েছি গো
                    অনেক নিয়েছি মা; তবু
                    জানিনে যে কিʼবা তোমায়
                    দিয়েছি মা।
                   আমার জনম গেলো বৃথা
                   কাজে ; আমি কাটানু দিন
                   ঘরের মাঝে ; তুমি বৃথাই
                   আমায় শক্তি দিলে
                  শক্তিদাতা! ও আমার দেশের
                 মাটি তোমার পরে ঠেকাই
                 মাথা।।

                                   
                                         অলংকরণ-সুমিত রায়

শীত গতপ্রায়

আবার একটা শীত গতপ্রায়; এই শীতেও তুমি জানলেনা হেমন্তের জাতক এক তোমাকে চাইতো অকারণ! মাঘের শেষবেলায় এ শহর অধিক কুয়াশায় ঢেকে যাবে, হু হু উত...